বোম্বাই রোড থেকে সরু সরু মাটির পথ বেরিয়ে গ্রামের দিকে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে সে ওইরকম এক পথের মুখে এসে পড়ল। কয়েকটা চালাঘরের দোকান। তার পাশে পাঁচিল—ঘেরা এক কারখানা। গোটাতিনেক একতলা কোয়ার্টার্স। একটা গ্রামেরও আভাস পাওয়া যায় গাছপালার আড়ালে।
কামারের দোকানের পাশে সাইকেল সারাই—এর দোকান, তার পরেরটি চায়ের। দোকানের বাইরে বাঁশের বেঞ্চে দুটি লোক বসেছিল সুটকেস আর থলি নিয়ে। বোধহয় এখানে বাস থামে। চন্দন তাদের পাশে বসল। হাতঘড়িতে সময় দেখল সাড়ে দশটা।
দোকানটির শীর্ণ এবং জীর্ণ দশার মতো দোকানিটিও। শাড়িটার রঙ একদা লাল ছিল বোঝা যায়। যেমন বোঝা যায় ওর গায়ের রং একদা গৌর ছিল। হয়তো দেহেও লাবণ্য ছিল এবং তারুণ্যও। এখন দু’চোখে খিটখিটে উত্তাপ এবং পাণ্ডুর মুখ। একটি বছর দশ বয়সের ছেলে কয়লা ভাঙছে।
”চা হবে?”
চন্দন গলাটা চড়িয়েই বলল।
”হবে।”
বিস্কুট চানাচুর, কেক ছাড়াও পাউরুটি এবং বাতাসাও আছে। পান, বিড়ি, সিগারেটও একপাশে। সবকিছুই কম দামি, দেখে মনে হয় এদের অনেকগুলিই দীর্ঘকাল পড়ে রয়েছে।
এই মেয়েটি বা বৌটিই তাহলে মালিক। এইতো দোকানের হাল, চলে কী করে? স্বামী হয়তো কোথাও কাজটাজ করে। এই সব ভাবতে ভাবতে চন্দন চারধারে চোখ বুলিয়ে, মেদিনীপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে যথেষ্ট রকমের মনজুড়ানো কিছু না পেয়ে আবার দোকানের দিকে তাকাল। তার মোটরটাকে সে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে।
দোকানে ছ্যাঁচা বেড়ায় একটা ফ্রেমে—বাঁধানো ছবি আটকানো। চন্দন অলস চোখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আন্দাজ করার চেষ্টা করল, ছবিটা কীসের। ছবি যতটা বিবর্ণ তার থেকেও অপরিচ্ছন্ন কাচটা। ঠাওর করতে না পেরে, কৌতূহলবশেই সে উঠে ছবির কাছে এল।
স্ত্রীলোকটি চা তৈরি করতে করতে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল। প্রায় উলঙ্গ ছেলেটি পিট পিট করে তাকিয়ে। বেঞ্চে—বসা লোকদুটি উঠেছে, বোধহয় বাস আসছে।
মলিন কাচের পিছনে, চন্দন ক্রমশ বুঝতে পারল, একটা ফুটবল টিম। আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে সে যা আবিষ্কার করল, তাতে চমকে ওঠারই কথা—আই এফ এ—র সাতচল্লিশ সালের টিম, যা বর্মা, সিঙ্গাপুর সফর করেছিল।
”এ ছবি এখানে কে টাঙালো?”
চন্দন স্ত্রীলোকটিকে লক্ষ্য করেই বলল।
”ওর বাবা।”
ছেলেটিকে মুখ তুলে দেখিয়ে দিল। ওর মুখের ভঙ্গির মতো কণ্ঠস্বরও কর্কশ।
ছবিটা যুগের যাত্রীর টেন্টেও টাঙানো আছে। যাত্রীর চারজন এই টিমে ছিল। তাদের নামগুলো চন্দন জানে।
”খুব বুঝি ফুটবল ভালোবাস?”
জবাব এল না। স্ত্রীলোকটির বদলে ছেলেটি বলল : ”বাবার ছবি আছে ওটায়।”
”ভাঁড়ে না গেলাসে?”
স্ত্রীলোকটি বিরক্তমুখে তাকিয়ে।
”ভাঁড়ে।”
চন্দন কৌতূহলভরে এবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, ”কোথায় তোমার বাবা?”
ও এগিয়ে এসে, মাটিতে—বসা চারজনের মধ্যে একজনের মুখে আঙুল রাখল।
শিবকৃষ্ণণ!
চন্দন ফ্যালফ্যাল করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ছবির দিকে মুখ ফেরাল।
যুগের যাত্রীরই শিবকৃষ্ণণ। ডাকসাইটে লেফট—ইন। ওর আমলে সব থেকে পপুলার প্লেয়ার। হায়দ্রাবাদের কোন এক গ্রাম থেকে বাচ্চচা বয়সে কলকাতায় এসে কালীঘাট, স্পোর্টিং ইউনিয়ন ঘুরে দু’বছর ইস্টবেঙ্গল খেলে যাত্রীতে আসে। যখন ও খেলা ছাড়ে তখন চন্দনের বয়স বছরচারেক। প্রবীণরা যখন পুরনো আমলের কথা বলে, তখন শিবকৃষ্ণণের নাম অবধারিতভাবেই ওঠে।
থ্রু পাশ দেবার নাকি মাস্টার ছিল। ধীর শান্তভাবে খেলত। হেডিং বা শু্যটিং তেমন ছিল না। খালি পায়েই খেলে গেছে। পায়ে আঠার মতো বল লাগিয়ে রাখত, জনাচারেককে অবহেলায় কাটাতে পারত। ‘শিবের মতো ইনসাইড আজ কলকাতার মাঠে নেই। এখন সামনে প্লেয়ার পড়লে কাটিয়ে বেরোতে কজন পারে? মনে আছে, কে ও এস বি—র হেন্ডারসনকে ছ’বার কীরকম কাটিয়েছিল।’
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। শিবের বল হোল্ড করে রাখা নাকি দেখার ছিল। ‘নষ্ট হল নেশা করে। গাঁজা, ভাং, চরস কিছুই বাদ ছিল না। এখনকার মতো পয়সা তো সে আমলে পেত না। তবু বিশ—পঁচিশ যা পেত, উড়িয়ে দিত। আহা, কী বল ছাড়ত!’
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। শিবের গান অনেকবার চন্দন শুনেছে। প্রথম দিকে বিস্মিত হত, পরের দিকে বিরক্ত। বুড়োদের কাছে যা কিছু ভালো, সবই পুরনো আমলের। তখন নাকি প্লেয়াররা আদা—ছোলা চিবিয়ে ক্লাবের জন্য জান দিয়ে দিত, টাকা পাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারত না। তখনকার প্লেয়াররা নাকি ভদ্রতায় বিনয়ে মাখনের মতো ছিল। ‘আজ যে যুগের যাত্রী দেখছ, এত টাকা, এত ট্রফি, এসবের শুরু ওই আমল থেকে। ওরাই ক্লাবকে প্রথম সাকসেস এনে দেয়। রোভার্সে, ডুরান্ডে—ফাইনালে, সেমি—ফাইনালে ক্লাবকে তোলে, যাত্রীকে পপুলার করে, অল ইন্ডিয়া নাম হয়।’
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। এসব কথা চন্দন মানে। বহু জায়গায় বক্তৃতায় সে ছোটদের উপদেশও দিয়েছে—বড়দের শ্রদ্ধা করবে, অতীতকে ভুলবে না। নিজেও সে অতীতের নামি ফুটবলার দেখলেই প্রণাম করে পায়ে হাত দিয়ে। তারপর দেখে চারপাশের লোক সপ্রশংস চোখে তার দিকে তাকিয়ে, তখন নিজেকে খানিকটা লম্বা মনে হয়।
”শিবকৃষ্ণণ তোমার বাবা?”
চন্দনের কণ্ঠে পরিষ্কার অবিশ্বাস। ছেলেটি লাজুক চোখে স্ত্রীলোকটির দিকে তাকায়।