পুরনো স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড। চন্দন ছ’হাজার টাকায় কিনেছে চার মাস আগে। গাড়ি—চালানোটা শিখবে শিখবে করেও এখনও শেখা হয়নি। ড্রাইভার রেখেছে। মাসে তিনশো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা ওর গায় লাগে। কেমন একটা ভয় ওর আছে, নিজে গাড়ি চালালে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলবে।
চারবছর আগে জ্যোতিষী কোষ্ঠীবিচার করে যা যা বলেছিল তার অধিকাংশই মিলে গেছে। যেমন বিদেশ—ভ্রমণ, যশ—খ্যাতি, আর্থিক সাফল্য, বিয়ে, চাকরি—সবই প্রায়। এশিয়ান গেমস খেলতে ব্যাঙ্কক, তেহরান, ইন্ডিয়া টিমের সঙ্গে হংকং, সিওল, নাইরোবি, সিঙ্গাপুর, কাবুল, কলম্বো, রেঙ্গুন। মারডেকা খেলতে দুবার কুয়ালালামপুরে। যশ ও খ্যাতি ব্যাপারটা কেমন চন্দন সেটা ঠিক বুঝতে পারে না। সে শুধু লক্ষ্য করেছে বাড়ির বাইরে মানুষজন তাকে দেখলেই তাকায়, মেয়েরা ফিসফাস করে। গাড়িওলা লোকেরা তাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে লিফট দিতে চায়, অপরিচিতরা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে, ফুটবল ফাইনালে পুরস্কার বিতরণ ও দুচার কথা বলার জন্য প্রায়ই ডাক আসে। তার নামে খবরের কাগজে হেডিং হয়। ‘চন্দনের সৌরভ’ বা ‘সুরভিত চন্দন’ জাতীয় বিশেষণ তার খেলার দক্ষতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। একবার ট্যাক্সিতে যাবার সময় কানে এসেছিল : ”ভগবানের ছেলে যাচ্ছে রে!” তার ক’দিন আগেই শীল্ড ফাইনালে, যুগের যাত্রী জিতেছিল তার দেওয়া একমাত্র গোলে। এ—সব ব্যাপার যদি যশ বা খ্যাতি হয় তাহলে চন্দন যশস্বী এবং খ্যাতিমান।
আর্থিক সাফল্য অবশ্যই চন্দন পেয়েছে। কোনোক্রমে স্কুল ফাইন্যাল পাশ। ক্লাবই ব্যাঙ্কে চাকরি করে দিয়েছে। এখন পাচ্ছে প্রায় আটশো। জ্যোতিষী বলেছিল গোমেদ আর পোখরাজ ধারণ করতে, করেছে। চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার তার দর উঠেছিল। সে বছরই। এখন সে ফ্ল্যাটের মালিক, বেনামিতে একটি ওষুধের দোকান করেছে, পঞ্চাশ হাজার টাকা খাটছে সুদে এবং সম্প্রতি এই গাড়িটি।
জ্যোতিষী বলেছিল, সুন্দরী বৌ পাবে, বতু অর্থাৎ ব্রততী প্রকৃত সুন্দরীই। চন্দনের ভক্ত এক ফিল্ম ডিরেক্টর ব্রততীর জন্য কিছুদিন ধরনাও দিয়েছিল। ফিল্মে নামাটা চন্দনের পছন্দ নয়। বতু তাকে ভালোবাসে এবং সে বতুকে। বতু চায় চন্দন স্মার্ট লোকদের মতো নিজেই গাড়ি চালাক। কিন্তু জ্যোতিষী বলেছিল ত্রিশ বছরের পর ফাঁড়া আছে, একটা মুক্তো ধারণ করলে হয়। তখন বয়স ছিল সাতাশ। ত্রিশ হোক তো, এই ভেবে মুক্তো আর ধারণ করা হয়নি, আজও হয়নি।
গাড়িটা কিনেই তার মনে পড়েছিল ফাঁড়ার কথাটা। শরীর ছমছম করে উঠেছিল। গোল এরিয়ার মধ্যে হিংস্রতম ডিফেন্ডারদের মোকাবিলায় যে কখনো ভয় পায়নি সেই চন্দন মিত্র গোপনে ভয় পায় অ্যাকসিডেন্টকে। হাত—পা—বিচ্ছিন্ন ধড়, গুঁড়িয়ে যাওয়া পাঁজর, তালগোল—পাকিয়ে চটকানো দেহ—নিজের এইরকম একটা চেহারা যখনই তার চোখে ভেসে ওঠে তখন কিছুক্ষণের জন্য সে বিমর্ষ বোধ করে। গাড়িতে দিঘা রওনা হবার সময় ড্রাইভার ত্রিপিত সিংকে বারবার নির্দেশ দিয়েছিল,—ত্রিশ মাইলের বেশি জোরে যাবে না, অন্য গাড়ির সঙ্গে রেস দেবে না, ওভারটেক করবে না, ট্রাক—বাস—লরি সামনে পড়লেই বাঁয়ে সরে যাবে।
এইসব বলার পর তার মনে হয়েছিল বয়সটা বোধহয় সত্যিই বেড়েছে। খেলার দিন যে ফুরিয়ে আসছে, তাতো এবারই বোঝা গেল। তন্ময়, বাসব, প্রদীপকে ট্রান্সফারের দশদিন আগে তুলে নিয়ে রেখেছিল, কিন্তু তাকে ছেড়ে রাখে। এক ধাক্কায় দশ হাজার টাকা এবার কমে গেছে।
বোম্বাই রোডের উপর, অচল গাড়িটার দিকে তাকিয়ে চন্দন ভাবল, বয়স বাড়ছে। দু—এক বছরের মধ্যেই টিম তাকে খারিজ করে দেবেই। আয় কমে যাবে। গাড়িটা কেনার কি কোনো দরকার ছিল? পাঁচ বছর আগেও তো ট্রাম আর বাস ছিল তার সম্বল। তারও আগে আধপেটা দিন আর এখানে ওখানে খেপ খেলা।
ত্রিপিত সিং খড়্গপুরে ফিরে গেছে ডিস্ট্রিবিউটর বক্সটা সঙ্গে নিয়ে। গোলমাল ওটাতেই ঘটেছে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে চন্দন খড়্গপুরগামী একটা ট্রাককে হাত তুলে থামতে বলেছিল। অগ্রাহ্য করে সেটা বেরিয়ে যায়। তার পিছনে একটা প্রাইভেট মোটর ছিল। আপনা থেকেই সেটা থামে। দরজা খুলে দিয়ে পিছনে—বসা লোকটি বলেছিল, আসুন।
চন্দন ঈষৎ গর্ব বোধ করেছিল। কিন্তু ত্রিপিত ছাড়া ব্যাপারটা দেখার জন্য আর কেউ ছিল না। গত বছরও দুটো পত্রিকা তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছে। লিগ এখন মাঝামাঝি, ইতিমধ্যে তিনবার তার ছবি বেরিয়েছে। কয়েক লক্ষ লোক তার মুখ চেনে। শুধুমাত্র তাকে দেখেই গাড়ি থামে, এখনও থামে। দর পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও। বাঙালিরা সত্যিই ফুটবল ভালোবাসে।
ওই গাড়িতে ত্রিপিত গেছে খড়্গপুর। ফিরতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। মনে হয়, ঘণ্টা দুই। গাড়ি পাহারা দেবার জন্য চন্দন রয়ে গেল। কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে নেমে, দরজা লক করে, সে পায়চারি শুরু করল।
রাস্তাটা এখানে, পাশাপাশি ছটা লরি যেতে পারে, এমন চওড়া। দুধারেই ক্ষেত, পাটের আর ধানের। প্রচণ্ড গরমের পর বৃষ্টি হয়ে গেছে দু’সপ্তাহ আগে। কাল রাতেও হয়েছে। দূরে জমিতে লাঙ্গল দিচ্ছে এক চাষি। চন্দন অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে, চায়ের জন্য তৃষ্ণা বোধ করল।