পরের ওভারে আটঘরার দুটো এল. বি. ডবল্যু. অ্যাপীল পোপীনাথ ঘোষ নাকচ করে দিলেন। মনে মনে আমরা খুশিই হলাম। আমাদের আম্পায়ারের নিরপেক্ষতা প্রমাণ হয়ে গেল। দ্বিতীয় উইকেট পড়ল ৪০ রানে। তিনটে ক্যাচ জমিতে পড়ল, চণ্ডী কম্পাউন্ডার এগারোটি ওয়াইড দিল এবং তার বলে ১৪টি বাইরান হওয়া সত্ত্বেও বকদিঘির স্কোর দাঁড়াল সাত উইকেটে ৮৬। তারপর ১০১—৮। ব্যাট করছে অতুল মুখুজ্যে, ছ—ফুট লম্বা, সাড়ে ৯৪ কেজি ওজন, আর বিষ্টু মিশির, সাড়ে—পাঁচ ফুট লম্বা এবং ওই একই ওজন। শর্ট রান নেবার সময় একবার ওদের পদভারে জমি কেঁপে উইকেটের বেল পড়ে গেল।
আটঘরার হার অবধারিত। বকদিঘি থেকে আসা লোকেরা হইহই শুরু করেছে। অতুল মুখুজ্যে স্টেডি ব্যাট। শুধু সিধে বলগুলো আটকে যাচ্ছে আর বাইরের বল ছেড়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, আলুর আড়তদার মিশিরজি ডাইনে ব্যাট চালিয়ে বাঁয়ে এক রান এবং বাঁয়ে ব্যাট চালিয়ে পিছন থেকে এক রান—এইভাবে বকদিঘিকে ১০৯ রানে নিয়ে গেল।
আর চার রান হলেই জিত। বকদিঘির হাতে দুটে উইকেট।
এমন সময় ঘটল সেই কাণ্ডটা।
পরমেশদার লোপ্পাই বল, পীচের মাঝামাঝি পড়ে বিষ্টু মিশিরের কাছে আর যেন পৌঁছয়ই না। বলটা এত স্লো ছিল। মিশিরজি প্রথমে ঠিক করেছিল, বাঁয়ে ঝাড়ু চালাবে। তারপর বলের গতি দেখে কেমন ভ্যবাচাকা খেয়ে বেলচা চালাবার মতো ব্যাটটাকে সামনে ছুঁড়ল বা চালাল। বলটা পীচের মাঝ—বরাবর সোজা আকাশে উঠে গেল।
আটঘরার সবচেয়ে বাজে কিন্তু সবচেয়ে উৎসাহী ফিল্ডসম্যান হোমিয়োপ্যাথ—ডাক্তার ভুবনেশ্বর সিঙ্গি ছিল মিড—অফ আর কভার পয়েন্টের মাঝামাঝি। দৌড়ে পীচের উপর গিয়ে, দু—হাতের মুঠো জড়ো করে অপেক্ষা করতে লাগল পড়ন্ত বলটি ক্যাচ করার জন্য।
সেই সময় মিশিরজি প্রাণঘাতী একটা চিৎকার করল অতুল মুখুজ্যের উদ্দেশ্যে—”রান।”
ব্যাটটাকে তলোয়ারের মতো সামনে ধরে মাথা নিচু করে বিষ্টু মিশির আর ব্যাটটাকে গদার মতো কাঁধে রেখে অতুল মুখুজ্যে—দু—দিকের উইকেটের দিকে দু—জনে রওনা হল। দুজনের মোট ওজন ১৯০ কেজির একটু বেশি বা কম।
ভুবনডাক্তার দেখতে পাচ্ছে, বরং বলা উচিত শুনতে পাচ্ছে—কেননা তখন সে মুখ তুলে বলের দিকে তাকিয়ে—ওরা দু—জন আসছে। ডাক্তার একটু নরম প্রকৃতির। সম্ভবত ওদের রান নেবার পথে বাধা না হবার জন্যই ভদ্রতাবশত সে পীচ থেকে সরে গেল।
কম্পাউন্ডার চণ্ডী চিৎকার করে উঠল, ”আরে ছাগল, ক্যাচটা যে নষ্ট হবে!”
ডাক্তার এক মুহূর্ত ইতস্তত করেই আবার পীচের উপর দুই স্টিমরোলারের মাঝে এসে দাঁড়াল। বলটা তার হাতে প্রায় পড়ছে বা পড়েছে, তখনই দু—দিক থেকে দু—জন এসে পড়ল তার উপর। তারপর তিনজনেই মাটিতে। কিন্তু তার মধ্যেই ডাক্তার সিঙ্গি দুই গন্ধমাদনের মাঝের ফাটল থেকে কোনোক্রমে মাথাটা বার করে জমি থেকে বলটা কুড়িয়ে তুলে ধরে একটা আওয়াজে করল। আওয়াজে অনেকটা এইরকম একটা বাক্যের আভাস পাওয়া গেল—”হাউজ দ্যাট।”
”আউট।” সময় নষ্ট না করে এম. পি. গোপীনাথ ঘোষ বললেন।
”কেন আউট?” বিষ্টু মিশির ব্যাটটা আবার তলোয়ারের মতো বাগিয়ে ধরেছে।
”অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড—আউট।” এরপর সবাইকে অবাক করে গোপীনাথ গড়গড়িয়ে মুখস্থ বলে গেলেন ক্রিকেটের ৪০ নম্বর আইনটা। মিশিরজি ইংরিজি বোঝে না। হতভম্ব হয়ে সে অতুল মুখুজ্যের দিকে তাকাল। অতুল মুখুজ্যে ইংরিজির এম.এ.। গম্ভীর হয়ে মিশিরের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল।
”বেশ। আইনে যদি বলে তাহলে তো আলবত আউট।” তারপর সন্দেহাকুল স্বরে বলল, ”কিন্তু কে আউট?”
মাঠ চুপ। সবাই তাকিয়ে গোপীনাথ ঘোষের দিকে। মনে হল, এই সমস্যার কী উত্তর হবে সেটা তাঁর জানা নেই। ক্রিকেট আইনগুলো ঠিকই মুখস্থ করেছেন, কিন্তু এইরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আইনে কী বলা আছে সেটা আর মুখস্থ করা নেই। পীচের ঠিক মাঝখানে, দু—দিক থেকে দু—জন এসে একই সঙ্গে ভুবন সিঙ্গির ঘাড়ে পড়েছে। দু—জনের মধ্যে কে অবস্ট্রাকশানের দায়ে অপরাধী?
”আমাদের মধ্যে কে আউট!” অতুল মুখুজ্যে বিস্ময় সহকারে বলল।
”দু—জনেই।” গোপীনাথ ঘোষ তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং জোড়া আঙুল তুলে ধরলেন।
আশ্চর্য, দুই ব্যাটসম্যানই আর কথা না বলে গুটিগুটি মাঠ ছেড়ে চলে গেল। আটঘরা জিতল তিন রানে। বকদিঘির ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস গুজগুজ করছিল বটে কিন্তু ভরসা করে প্রতিবাদ জানাতে এগোয়নি। আইন—কানুন কারুরই তো জানা নেই।
দিনসাতেক পরই পতু মুখুজ্যে ঝড়ের মতো সাইকেল চালিয়ে পরমেশদার বাড়িতে হাজির হয়েছিল। হাতে একটা উইজডেন।
”এম.পি. আম্পায়ারকে দিয়ে আটঘরা আমাদের হারিয়েছে। মামলা করব আমি।” চিৎকার করতে করতে পতু মুখুজ্যে উইজডেন খুলল। ”এই দ্যাখ, খুদে খুদে অক্ষরে কী লেখা রয়েছে।”
পরমেশদা আড়চোখে লালকালির দাগ দেওয়া শেষের কথাগুলো দ্যাখে : ”ইট ইজ দ্য স্ট্রাইকার হু ইজ আউট।”
”একজনই আউট হয়, দু—জন নয়, আর তোদের এম.পি…. ঠিক আছে সামনের বার আমরাও এম্পিয়ারিং দেখাব।”
বৃদ্ধ বট
গাড়িটা যে এইভাবে পথে বসাবে, চন্দন মিত্র তা ভাবতে পারেনি।
ভোরে দিঘা থেকে রওনা হয়ে খড়্গপুর পর্যন্ত মসৃণভাবে এসেছে। ব্রততী আর একবছরের বাবলুকে জামসেদপুরের ট্রেনে তুলে দিয়েছে চন্দন। ব্রততী যাবে বড়দিদির কাছে, থাকবে দিনপনেরো। দিঘায় ওরা দুদিন ছিল চন্দনের এক অনুরাগীর বাড়িতে।