গোপীনাথ ঘোষের কাছে গিয়ে কথাটা পাড়ামাত্রই তিনি রাজি। আমরা মুখ চাওয়া—চাওয়ি করলাম। এত তাড়াতাড়ি রাজি হবেন ভাবিনি।
”তবে ভাই, ক্রিকেট আইনের বিন্দুবিসর্গও জানি না। জীবনে ক্রিকেটও খেলিনি।” একগাল হেসে এম পি গোপীনাথ ঘোষ বললেন।
”তাতে কী হয়েছে।” পরমেশদা একজন এম. পি.—আম্পায়ার মাঠে নামানোর কৃতিত্ব থেকে আটঘরাকে বঞ্চিত করতে রাজি নয়। ”এখনও চারদিন তো হাতে রয়েছে। অ আ থেকে বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত আইন আপনার জানা আছে। জলের মতো সোজা, সংবিধানের ধারা—উপধারার থেকেও সরল ব্যাপার।”
নন্তু দত্ত বলল, ”শুধু মুখস্থ করে ফেলুন, স্যার। আপনার মতো লোক, যাঁর সঙ্গে বাঘা—বাঘা মিনিস্টাররা পর্যন্ত আইন—টাইন নিয়ে ডিবেট করতে ভয় পায় তাঁর কাছে উইজডেন তো—” তুড়ির পটাস শব্দ হল।
আমি বললাম, ”আসলে যেটা দরকার, তা হল ব্যক্তিত্ব। ওটা থাকলে কেউ আর ট্যাঁফোঁ করতে সাহস পাবে না। বকদিঘির পতু মুখুজ্যে টেঁটিয়া ক্যাপ্টেন, আম্পায়ারকে ঘাবড়ে দিতে দারুণ ওস্তাদ। আপনার মতো ব্যক্তিত্ববান, রাশভারি লোক মাঠে থাকলে—”
”বুকের পাটা স্যার, শুধু এইটুকু। আপনি যা বলবেন সবাই মানতে বাধ্য এই কথাটা আর উইজডেন—এই দুটো মনে রাখা, তাহলেই আম্পায়ার।”
গোপীনাথ ঘোষ শুনতে শুনতে মাথা নেড়ে গেলেন। আমরা অনেকটা আশ্বস্ত হলাম।
পরদিনই পরমেশদা আর আমি উইজডেন নিয়ে গেলাম। যাবার সময় পরমেশদা আমায় বোঝাল, ”রাজনীতি যারা করে—টরে, তাদের নাকের সামনে আইন—কানুন, ধারা—উপধারা এইসব যদি ঘাসের আঁটির মতো ধরিস, দেখবি লোভ সামলাতে পারবে না।”
পরমেশদা কথায় কথায় উইজডেনের পাতা উলটে গোপীনাথ ঘোষের সামনে এগিয়ে ধরে বলল, ”এই ৩৫ নম্বর আইনটা, কী যে অদ্ভুত রকমের। ব্যাটসম্যান কট আউট হবে যদি ফিল্ডসম্যান বলটিকে দেহের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে। উইকেটকিপারের প্যাডের মধ্যে বল ঢুকে গেলেও কট আউট হবে—আচ্ছা কাণ্ড! আঁকড়ে ধরা আর ঢুকে যাওয়া দুটো কি এক হল?”
”বটে বটে, ইন্টারেস্টিং তো!”
পরমেশদা আবার ঘাসের আঁটি এগিয়ে ধরল।
”কুড়ি নম্বর আইনের চারের উপধারা—”, উইজডেনের পাতা ওলটাল পরেমেশদা, ”বলছে, আম্পায়ার বাউন্ডারি নয়।”
”য়্যাঁ, তাই নাকি! যদি হত তাহলে তো আম্পায়ারকে লক্ষ্য করেই সবাই বল পেটাত। কী সর্বনাশ! খুব ভেবেচিন্তে আইন করেছে তো। দেখি, দেখি বইটা।”
আমরা প্রচুর আশ্বস্ত হয়ে বইটা ওঁর হাতে তুলে দিয়ে চলে এলাম। খেলার আগে কটা দিন আমরা দু—বেলা যেতাম। উনি একগাল হেসে শুধু বলতেন, ”দারুণ, দারুণ বই। মুখস্থ হয়ে এল প্রায়।”
খেলার দিন গোপীনাথ ঘোষ উইজডেন হাতে এলেন। মাঠের ধারে চেয়ারে বসে মন দিয়ে পড়তে শুরু করলেন। দেখে একটু দমে গেলাম। এখনও মুখস্থ হয়নি, তার উপর প্রকাশ্যে এইভাবে পড়তে দেখলে বকদিঘির লোকেরাই বা কী ভাববে!
”সব রকম ভেবেচিন্তেই দেখছি আইন করেছে। বল আম্পায়ারের গায়ে লাগলে ডেড হবে না, তার পকেটে কি কাপড়চোপড়ের কোথাও আটকে গেলে তবেই হবে। উফ, কী দূরদৃষ্টি! এবার পার্লামেন্টের লাইব্রেরিতে উইজডেন রাখার জন্য মোশান আনব।”
গোপীনাথ ঘোষকে থামিয়ে নন্তু দত্ত শুধু মনে করিয়ে দিল, ”স্যার, ব্যক্তিত্বের কথাটা ভুলে যাবেন না যেন।”
পতু মুখুজ্যের গলা শোনা গেল। ”তোদের আম্পায়ার কে হবে রে?”
পরমেশদা উদাসীন ভঙ্গিতে বলল, ”পার্লামেন্টে কোম্পানি ল সাবকমিটির মেম্বার গোপীনাথ ঘোষ আমাদের আম্পায়ার। তোমাদের?”
পতু মুখুজ্যে কেমন যেন চুপসে গেল। আমতা আমতা করে বলল, ”আমাদের তো বরাবরের মতোই হরিশ কর্মকার।”
বকদিঘি ড্রামাটিক সোসাইটির প্রম্পটার হরিশ কর্মকার। টসে জিতে বকদিঘি আমাদের ব্যাট করতে দিল। মেপে পা ফেলে গোপীনাথ ঘোষ উইকেটের দিকে এগোলেন। অবয়ব থেকে রাশভারিত্ব বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তাঁর পিছনে হরিশ কর্মকার যেন বাঘের পেছনে ফেউ। বকদিঘির ফিল্ডাররা এমন বোমকে গেছে যে অন্যান্যবারের মতো ক্যাচ লোফালুফি করে মাঠে নামতে পর্যন্ত ভুলে গেল। শুধু তাস নয়, কারণে—অকারণে বকদিঘির বোলার, উইকেটকিপার, বলতে বলতে প্রায় গোটা টিমই চিৎকার করে যেরকমভাবে অ্যাপীল করে থাকে, তার কিছুই হল না। এমন নিঃসাড়ে খেলা হতে লাগল যে আটঘরার ব্যাটসম্যানরা নার্ভাস হয়ে পড়ল।
বকদিঘির বোলার মুকুন্দ মালখণ্ডি যখন অ্যাপীল করে, আশপাশের গাছ থেকে পাখিরা ভয়ে উড়ে যায়। মুকুন্দ শুধু একবারই অ্যাপীল করেছিল এবং অত্যন্ত সম্ভ্রমভরে, নম্র এবং এতই মৃদুকণ্ঠে যে গোপীনাথ ঘোষ তা শুনতেই পাননি। সোজা তাকিয়ে রইলেন গম্ভীরমুখে। মুকুন্দই শুধু নয় হরিশ কর্মকার পর্যন্ত সেই রাশভারি মৌন—নাকচে এতই জড়োসড়ো বোধ করল যে, পরের ওভারে আমার উইকেটের সামনে রাখা পায়ে সোজা বল এসে লাগলেও কর্মকার নট আউট বলে দেয়।
আটঘরার ইনিংস ১১২ রানে শেষ হল। বকদিঘির প্রথম উইকেট পড়ল শূন্য রানে। পতু মুখুজ্যে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল কাস্তে চালাবার মতো কাট করতেই খিচিং অর্থাৎ স্নিক। উইকেটকিপার ক্যাচ ধরেই অ্যাপীল করল এবং গোপীনাথ ঘোষ আঙুল তুললেন। এক্ষেত্রে পতু মুখুজ্যে বলটা প্যাডে বা বুটে লেগেছে বলে সচরাচর তর্ক শুরু করে। এবার একটি কথাও না বলে মাথা নিচু করে উইকেট থেকে চলে গেল।