ফাইনাল পর্যায়ের জন্য ২৪টি দলকে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয় লটারির মাধ্যমে। চারটি প্লাস্টিক ভাণ্ডে প্রথমে দলগুলির নামে রঙিন ছোট ছোট বল রাখা হয়। প্রথম ভাণ্ডে ছিল ছয়টি বাছাই দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্তিনা, জার্মানি, ব্রাজিল, ইতালি ও বেলজিয়াম, দ্বিতীয়টিতে ছিল ইউরোপের ছয়টি দেশ—স্পেন, রাশিয়া, হল্যান্ড, রোমানিয়া, বালগেরিয়া ও আয়ার্ল্যান্ড। তৃতীয়টিতে ছিল আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি—মরক্কো, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, মেক্সিকো, বলিভিয়া ও কলম্বিয়া। চতুর্থটিতে ছিল অন্যান্য বহিরাগতরা—সুইডেন, সুইৎজারল্যান্ড, গ্রিস, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও নরওয়ে।
সবাই ভেবেছিলেন অনুষ্ঠাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে সহজ গ্রুপে রাখা হবে যাতে তারা দ্বিতীয় রাউণ্ডে উঠতে পারে। গত তিনটি বিশ্বকাপে সেইভাবেই গ্রুপ ভাগ করে আসা হয়েছে। গ্রুপ বিন্যাসের লটারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৩ ডিসেম্বরে লাস ভেগাসে। ১২৫ দেশের প্রায় ৫০ কোটি টি ভি দর্শক অনুষ্ঠানটি দেখেন। এই অনুষ্ঠানেই ফিফার নবপ্রবর্তিত ‘ওয়ালর্ড ফুটবলার অব দ্য ইয়ার’ (১৯৯৩) নির্বাচিত হন ইতালির রোবার্তো বাজ্জিও। ফাইনাল পর্যায়ের খেলা ১৭ জুন শুরু হয়ে শেষ হবে লস অ্যাঞ্জেলিসে ১৭ জুলাই।
এইবারের বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে পয়েন্ট দেওয়ার ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটান হল গতবারের রক্ষণাত্মক ও বিরক্তিকর খেলার কথা মনে রেখে। খেলাকে আক্রমণাত্মক করে তোলার ইচ্ছায় ফিফা স্থির করে প্রথম রাউণ্ডে বিজয়ী দল চিরাচরিত দুই পয়েন্টের বদলে তিন পয়েন্ট পাবে। এর ফলে রক্ষণাত্মক দলগুলির বিপদে পড়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়। ছয় গ্রুপের ১২টি দলের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউণ্ডে আরও যে চারটি দল উঠবে তারা নির্বাচিত হবে গ্রুপে তৃতীয় সেরা স্থান পাওয়াদের মধ্য থেকে।
এম্পিয়ারিং
এম্পিয়ারিং – মতি নন্দী – কিশোর ছোট গল্প
এম্পিয়ারিং
জাপানি বোমার ভয়ে, কলকাতা অর্ধেক খালি করে একবার মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্রামে ছুটে গিয়েছিল। আমরাও গিয়েছিলাম আটঘরায়। তারকেশ্বর থেকে খুদে রেল বি—পি—আরে চড়ে আটঘরা মাইলসাতেক। রেলগাড়ি উঠে গিয়ে এখন অবশ্য বাস চলছে। যেমন, তখনকার তিনটে চালাঘর নিয়ে হাইস্কুলটা এখন বিরাট তিনতলা পাকা বাড়ি। আমাদের এই বাৎসরিক, আটঘরার সঙ্গে পাশের গ্রাম বকদিঘির ক্রিকেট ম্যাচের পত্তন সেই সময় থেকেই।
তখন বাংলায় জমিদাররা ছিল। আটঘরায় ছিল সিংহরা, বকদিঘিতে মুখুজ্যেরা; কর্নওয়ালিস যেদিন থেকে জমিদার তৈরির কাজে হাত দেয়, সেই দিন থেকেই নাকি সিংহ আর মুখুজ্যেদের মধ্যে ঝগড়া, খুনোখুনিরও পত্তন। কালক্রমে সেই বিবাদের চেহারা বদল হতে হতে অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সেটা বাৎসরিক ক্রিকেট ম্যাচের রূপ নেয়। ডিসেম্বরে বড়দিনের সপ্তাহে ম্যাচটি খেলা হয়। এ পর্যন্ত ফল আটঘরার ১২টি জিত, বকদিঘির ১৩টি। একটিও ড্র হয়নি। খেলাটা হয় হোম—অ্যাওয়ে প্রথায়। একবছর বকদিঘির ফুটবল মাঠে, পরের বছর আটঘরার রথতলায়।
এত বছর ধরে খেলা হচ্ছে, তাই দুই গ্রামের লোকই ক্রিকেটে বেশ রপ্ত হয়ে গেছে। মেডেন ওভারে হাততালি দেয়, এমনকি খোঁচা মেরে রান পেলে মুচকে হেসেও ফেলে। বকদিঘির উইকেটকিপার পঞ্চু কলুর বৌ বা আটঘরার দৈত্য—প্রমাণ ফাস্টবোলার চণ্ডী কম্পাউন্ডারের মা—ও এই খেলা দেখতে মাঠে আসে। যাদের মাঠে খেলা, তারাই লাঞ্চ দিত বিপক্ষকে। কিন্তু বছরছয়েক আগে বকদিঘির লাঞ্চ খেয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই আটঘরার পুরো টিমটা ফিল্ড করার বদলে মাঠ ছেড়ে পাশের ঝোপঝাড়ে—ভরা মাঠে জরুরি কাজে ফিল্ড করতে ঘন ঘন ছুটে যাওয়ায় আটঘরা হেরে যায়। তখন থেকেই ‘নিজেদের—লাঞ্চ— নিজেদের’ রীতিটি চালু হয়।
খেলার সাতদিন আগে থেকেই সিংহ আর মুখুজ্যে বংশের লোকেরা গ্রামে আসতে শুরু করে। একজন লোকসভা সদস্যও সেবার হাজির। ম্যাচের নিয়ম, দু—জন আম্পায়ার থাকবে দু—পক্ষ থেকে। আটঘরা হাইস্কুলের অঙ্কের মাস্টার বুদ্ধদেববাবু গত তিনবছর আম্পায়ারিং করছেন, এবার তিনি নারাজ। গতবছর তাঁর দেওয়া তিনটি রান আউট, দুটি এল. বি. ডব্লু আটঘরার পাঁচ উইকেটে হারায় প্রভূত সাহায্য করে। মাসচারেক তিনি হাট, পোস্ট অফিস, হেলথ সেন্টার কোথাও যেতে পারেননি। কানাঘুষো শোনা যায়, বকদিঘি ইস্কুলের সেক্রেটারি বনমালী মুখুজ্যে নাকি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার পদে যোগ দেবার জন্য বুদ্ধদেববাবুর কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন। কেউ বলে, পঞ্চু কলু নাকি প্রতিমাসে এক কেজি নির্ভেজাল তেল বুদ্ধুস্যারকে পাঠাচ্ছে।
আমি, পরমেশদা—পরমেশ সিংহ—আর নন্তু দত্ত প্রচুর অনুনয়—বিনয় করেও বুদ্ধদেববাবুকে রাজি করাতে পারলাম না। তাঁর এক কথা : ”আমি ভিলিফায়েড বাই—মাই ফ্রেন্ডস অ্যান্ড নেইবারস, ইভন বাই মাই পিউপিলস। অনেস্টলি আম্পায়ারিং করে দিস প্রাইস দিতে হল! য়্যাঁ, বলে কিনা সরষের তেল দিচ্ছে! আমি কিনা ব্রাইবড!”
নন্তু দত্তই প্রস্তাব দিল, ”চলো গোপীনাথবাবুর কাছে। পার্লামেন্টের মেম্বার, তার উপর উনি সিংহ নন, সুতরাং নিরপেক্ষ। ওনার ডিসিশনের উপর কথা বলবে, এত সাহস গোটা হুগলী জেলার কারুর নেই।”