১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের জন্য চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি (এখন শুধুই জার্মানি) ও অনুষ্ঠাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র বাদে, ২২টি দল নির্বাচনের প্রাথমিক বাছাই পর্বে যোগ দেয় রেকর্ড সংখ্যক ১৪১টি দেশ। মোট ৫৮২টি প্রাথমিক পর্বের প্রথম ম্যাচটি খেলা হয় ২২ মার্চ, ১৯৯২—এ। স্যান্টো দ্যোমিঙ্গোয় এই ম্যাচে পোর্তো রিকো ২—১ হারায় দমিনিকান রিপাবলিককে। এর ১৪ মাস পর ফাইনাল পর্যায়ে প্রথম যে দেশ উত্তীর্ণ হল, তারা গতবারের বিশ্বকাপ নিষেধাজ্ঞার জন্য অংশ নিতে পারেনি। দেশটি হল মেক্সিকো। এই নিয়ে তারা দশমবার ফাইনাল পর্যায়ে উঠল।
নরওয়ে ৫৬ বছর প্রতীক্ষার পর দ্বিতীয়বার ফাইনাল পর্যায়ে উঠে এল। সুইৎজারল্যান্ড উঠল ২৮ বছর পর অথচ যোগ্যতা পর্বে যে পর্তুগীজরা তাদের ১—৬ গোলে হারিয়েছিল সেই পর্তুগাল ফাইনাল পর্যায়ে যেতে পারল না। একই ভাগ্য হল ইংল্যান্ডেরও। হল্যান্ডের কাছে যোগ্যতা পর্বে ০—২ হারার পর ফাইনালে উঠার একটাই উপায় তাদের কাছে খোলা ছিল—যদি পোল্যান্ডের কাছে হল্যান্ড হারে আর ইংল্যান্ড যদি সাত গোলের ব্যবধানে সান মারিনোকে হারাতে পারে। কিন্তু হল্যান্ড ৩—১ জিতল আর ইংল্যান্ড জিতল ৭—১। সান মারিনোর গোলটি হয় খেলার ১০ সেকেন্ডে, ৭০২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ইংল্যান্ড আগে কখনও এত দ্রুত গোল খায়নি। ওয়েলস, স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ার্ল্যান্ড ও ইংল্যান্ড যোগ্যতা পর্ব অতিক্রম করতে না পারার ১৯৫০—এর পর, এই প্রথম ফাইনাল পর্যায়ে কোন ব্রিটিশ দল রইল না। ১৯৫৮—র পর প্রথমবার হয়তো ওয়েলস ফাইনালে উঠতে পারত যদি রোমানিয়ার বিরুদ্ধে ১—১ অবস্থায় তাদের পল বোডিন পেনাল্টি নষ্ট না করতেন। ঘিয়র্ঘি হাজি ২—১ করে রোমানিয়াকে জেতান। ইওরোপের তৃতীয় গ্রুপের শেষ খেলায় স্পেনের কাছে (১৯ পয়েন্ট) ডেনমার্ক (১৮ পয়েন্ট) ০—১ হেরে যাওয়ায় ও আয়ার্ল্যান্ড (১৮ প) উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের (১৩ প) সঙ্গে ১—১ করায় গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় দল হিসাবে ফাইনালে ওঠে আয়ার্ল্যান্ড নিছকই গোল পার্থক্যের কারণে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের অনুষ্ঠাতা দেশ ফ্রান্সের এবারের যোগ্যতা পর্বেই বিদায় নেওয়াটা ঘটে বালগেরিয়া সঙ্গে শেষে খেলার শেষ মিনিটে। খেলা অমীমাংসিত রাখলেই ফ্রান্স ফাইনাল পর্যায়ে চলে যাবে এবং খেলার ফল ৮৯ মিনিট পর্যন্ত যখন ১—১ তখনই এমিল কোস্তাদিনভ ২—১ করে দেন। দলের দুটি গোলই তার। ফ্রান্স এর একমাস আগে ২—৩ হেরেছিল ইজরায়েলের কাছে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে রাশিয়াকে ১—০ হারিয়ে গ্রিস অপরাজিত থেকে শীর্ষস্থান পায়। তবে দুটি দেশই ফাইনাল পর্যায়ে ওঠে।
দুবার চাম্পিয়ন ও দুবার রানার্স আর্জেন্তিনা কোনক্রমে যোগ্যতা পর্ব থেকে উঠে আসে শেষ খেলায় অস্ট্রেলিয়াকে ১—০ হারিয়ে। তার আগে অপ্রত্যাশিত ০—৫ গোলে স্বদেশে হারে কলাম্বিয়ার কাছে। ব্রাজিলেরও প্রায় একই হাল হয়। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে গ্রুপের শেষ খেলায় অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যাওয়া ব্রাজিল স্পেনের বার্সিলোনা ক্লাব থেকে সঙ্কট মোচনের জন্য ডেকে আনে রোমারিওকে। তার দেওয়া দুটি গোলের কৃপায় ব্রাজিল ফাইনাল পর্যায়ে উঠে আসে। আফ্রিকা থেকে যোগ্যতা পাওয়া তিনটি দেশের মধ্যে প্রথমবার সফল হওয়া নাইজেরিয়া ব্রিটেনের কাছ থেকে ৩৪ বছর আগে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছিল ফাইনাল পর্যায়ে ওঠার। তারা এখন অনূর্ধ ১৭ বছর বয়সীদের বিশ্ব ফুটবল চ্যাম্পিয়ন। নাইজেরিয়া দল ”সুপার ঈগলস” নামে পরিচিত, দলের অনেকেই ইওরোপের ক্লাবগুলিতে খেলেন।
বিশ্বকাপ ফুটবলের বিষাদময় ঘটনা ঘটল ১৯৯৩—এর ২৮ এপ্রিল যখন জাম্বিয়ার ১৮ জন বিশ্বকাপ ফুটবলার বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। কিন্তু জাম্বিয়া পাঁচ মাসের মধ্যেই একটি ফুটবল দল তৈরি করে নেয় ঘরোয়া অনভিজ্ঞদের ও ইওরোপের ক্লাবে খেলা চারজন ফুটবলারকে নিয়ে। এর পর মরক্কোকে ২—১ হারিয়ে সেনেগলের সঙ্গে ০—০ ও ৪—০ জিতে এমন অবস্থায় আসে যে মরক্কোর সঙ্গে ফিরতি খেলাটি অমীমাংসিত রাখলেই ফাইনাল পর্যায়ে উঠে যাবে। কিন্তু ম্যাচটি কাসাব্লাঙ্কায় তারা ০—১ গোলে হেরে যায়। সামান্যের জন্য ব্যর্থ হওয়া জাম্বিয়া পায় বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের সমবেদনা ও অভিনন্দন।
এবারের বিশ্বকাপ যোগ্যতা পর্বে এশিয় অঞ্চলকে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। ২৯টি দেশ অংশ নেয়। ‘ডি’ গ্রুপে ভারতের সঙ্গে ছিল—দক্ষিণ কোরিয়া, বাহরিন, হংকং ও লেবানন। বেইরুটে গ্রুপের প্রথমার্ধের ম্যাচগুলিতে ভারত ২—২ করে লেবাননের সঙ্গে, ১—২ হারে হংকংয়ের, ১—২ হারে বাহরিনের এবং ০—৩ হারে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। সোল—এ গ্রুপের দ্বিতীয়ার্ধের ম্যাচগুলিতে ভারত ০—৩ হারে বাহরিনের, ০—৭ হারে দক্ষিণ কোরিয়ার, ১—২ হারে লেবাননের কাছে এবং ৩—১ গোলে হারায় হংকং—কে। এশিয় অঞ্চল থেকে ফাইনাল পর্যায়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে দক্ষিণ কোরিয়া এবং প্রথমবার সৌদি আরব। বলিভিয়া এবং গ্রিসও প্রথমবার ফাইনাল পর্যায়ে উঠে এল নাইজেরিয়া ও সৌদি আরবের সঙ্গে।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের ম্যাচগুলি খেলার জন্য নির্বাচিত হয় নয়টি শহর—বোস্টন, শিকাগো, ডালাস, ডেট্রয়েট, লস অ্যাঞ্জেলিস, নিউ ইয়র্ক, অরল্যান্ডো, সান ফ্রান্সিসকো এবং ওয়াশিংটন। এর মধ্যে বিস্ময়কর ডেট্রয়টের পণ্টিয়াক সিলভারডোম ইনডোর স্টেডিয়ামের নির্বাচন। ফাইবার গ্লাস দিয়ে আদ্যন্ত ঢাকা, ৭২,৭৯৪ জন দর্শক বসার এই বাতানুকূল সিন্থেটিক গ্লাসের স্টেডিয়ামে শক্ত গোড়ার ঘাস জন্মানো সম্ভব নয়। বুট পায়ে একবার ছুটলেই ঘাস উঠে যাবে। ফিফা বিশ্বকাপ নিয়মে আছে প্রাকৃতিক ঘাসের মাঠে খেলা হতে হবে। স্থানীয় সংগঠকরা জানালেন, ফিফা—র চাহিদামত মাঠ তারা তৈরি করবেন। তাদের এই প্রতিশ্রুতির পিছনে ছিল মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির তিনজন তৃণ গবেষকের দেওয়া আশ্বাস আর তাদের উপর সংগঠকদের বিশ্বাস। রৌদ্রালোকের অভাব ও অসংখ্য বাধা অতিক্রমের জন্য ক্যালিফোর্ণিয়ায় উন্মুক্ত জায়গায় ঘাসের মূল বসিয়ে তাকে পুষ্ট ও সজীব করে তুলে মিশিগানে পাঠান হয়। সেখানে সাড়ে সাত ফুট চওড়া ষড়ভুজাকার ধাতব পাত্রের উপরিভাগে ছয় ইঞ্চি মাটি রেখে সেই ঘাস রোপণ করা হয়। ১৯৯৩ জুন মাসে এখানে ইউ এস কাপ ‘ড্রেস রিহার্সাল’—এর জন্য একটি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের ব্যবস্থা হয়েছিল। খেলার কয়েকদিন আগে ধাতবপাত্রগুলি (এক একটির ওজন ৩০০০ পাউণ্ড) সিলভারডোমের মাঠে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়। খেলাটি স্বচ্ছন্দ্যে হয় এবং ঘাসের কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু দু সপ্তাহ ধরে চারটি বিশ্বকাপের ম্যাচ এখানে খেলা হবে, তখন মাঠটির অবস্থা কেমন হবে তা জানার জন্য ফুটবল বিশ্ব উৎসুক হয়ে থাকবে। এই সিলভারডোমেই ইউ এস কাপ ফাইনাল খেলেছে জার্মানি ও ইংল্যান্ড। জার্মান কোচ বার্টি ফোগৎস বলেছেন : মাঠটা একটা মিরাক্যাল। ফিফা জনসংযোগ কর্তা তোগনোনি বলেছেন: বিশ্বকাপ মানেরও ঊর্ধ্বে এই মাঠ। ফিফা মহাসচিব ব্ল্যাটার বলেন : ঘাসের এই জমির গুণগত মান এমনই অসাধারণ যে, তারিফ আর প্রশংসা ছাড়া আর কিছু বলার নেই।