১৯৯০ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ইতিহাসে এশিয়ান দেশগুলি জিতেছে একটি মাত্র ম্যাচ। সেটি ঘটে ১৯৬৬ বিশ্বকাপে, উত্তর কোরিয়ার কাছে ইতালির ১—০ হারে। এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি তাদের তিনটি ম্যাচেই পরাজিত হয়। আরবরা সর্বাধিক গোল খায়—১১টি। গতি ছাড়া কোরীয়দের খেলায় আর কিছু ছিল না। তিনটি ম্যাচে তারা গোলে শট নিতে পেরেছে মাত্র ছয়বার। তারা ফাউলও করে সর্বাধিক—৮৮টি। গড়ে ম্যাচ পিছু প্রায় ৩০টি। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে কোরীয়দের ফাউল ছিল ৩৬টি। ১৯৮২ থেকে তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের হিসাব থেকে দেখা যায় এশিয় দেশগুলি ১৫ ম্যাচের একটিও জিততে পারনি, ড্র দুটি এবার হার ১৩টি। গোল দিয়েছে ১২, খেয়েছে ৪৬। এরই পাশাপাশি, আফ্রিকার দেশগুলি এই তিন বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচের ছয়টিতে জিতেছে, আট ড্র ও সাতটিতে হেরেছে। পক্ষে গোল ১৮, বিপক্ষে ২৪। আফ্রিকা যে ফুটবল শক্তিরূপে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেটা ক্যামেরুনের চাঞ্চল্যকর সাফল্য থেকে আরও ভালভাবে বোঝা গেল। বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ে তাদের আরও একটি দেশকে স্থান দেবার জন্য আফ্রিকা চেষ্টা চালাচ্ছিল অবশেষে তারা সফল হল। ফিফা প্রেসিডেন্ট জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ এবারের প্রতিযোগিতার মাঝেই ঘোষণা করলেন, ১৯৯৪ বিশ্বকাপে আফ্রিকা থেকে তৃতীয় একটি দেশ স্থান পাবে এবং সেজন্য ইওরোপের ১৩ দেশ থেকে একটি দেশ কমবে। ফিফা নথিভুক্ত ফুটবলারের সংখ্যা এখন আফ্রিকায় ৫০ লক্ষ, এশিয়ায় ৫ কোটি ৪০ লক্ষ, ইওরোপে ২ কোটি ৮০ লক্ষ ও দঃ আমেরিকায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ।
১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের জন্য দুটি দল বাছাইয়ের প্রতিযোগিতায় এশিয় অঞ্চলের ২৫টি দেশ নিয়ে ছয়টি গ্রুপ গঠিত হয়। চতুর্থ গ্রুপের লীগে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও নেপালের সঙ্গে ছিল ভারত। কিন্তু লীগ শুরুর আগেই ভারত নাম প্রত্যাহার করে নেয়।
ফাইনাল খেলার নির্ধারিত সময় শেষ হবার পাঁচ মিনিট আগে, রোবার্তো সেনসিনি রুডি ফোলারকে ফাউল করায় মেক্সিকান রেফারি কোদেসাল যে দণ্ড দেন তাই থেকে পশ্চিম জার্মানির আন্দ্রিয়াস ব্রেহমে—র পেনাল্টি শট আর্জেন্তিনার খেতাব রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা শেষ করে দেয় রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। সারা ম্যাচে আর্জেন্তিনা গোলের দিকে একটি মাত্র শট নিতে পেরেছিল। তারা নয়জন খেলোয়াড় নিয়ে ম্যাচ শেষ করে। ৬৫ মিনিটে পেদ্রো মোনজোন ও ৮৭ মিনিটে গুস্তাভো দেজোত্তি মাঠ থেকে বহিষ্কৃত হন। বিশ্বকাপ ফাইনালে বহিষ্কারের এহেন ঘটনা এই প্রথম। দক্ষিণ আমেরিকানদের লক্ষ্য ছিল নিজ মহাদেশের বাইরে, ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় দেশ রূপে বিশ্বকাপ জয়। বদলে তারা অর্জন করল ঈর্ষার অযোগ্য একটি রেকর্ড—বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করতে না পারা প্রথম দল। সাসপেণ্ড থাকায় ক্যানিজ্জিয়াসহ চারজনকে মাঠের বাইরে রেখে আর্জেন্তিনা নির্ভর করেছিল মাঝ মাঠ বন্ধ রাখার এবং সারা প্রতিযোগিতায় তারা যা করে এসেছে, রক্ষণাত্মক আঁটসাট নজরদারী খেলার উপর। পশ্চিম জার্মানি জোর দিয়েছিল অবিরাম আক্রমণে আর সেজন্য মধ্যমাঠে পিয়ের লিটবারস্কি ও টোমাস হ্যাসলার অক্লান্ত ভাবে বল যুগিয়ে গেছেন ক্লিন্সমান ও ফোলারকে। অন্যদিকে মারাদোনাকে নড়াচড়ার কোন সুযোগই দেননি গুইডো বুখভাল্ড এবং আর্জেন্তিনা অধিনায়ক কখনও যদি বা বলে পা ছুঁইয়েছেন অমনি সারা স্টেডিয়ামে বিদ্রুপ ধ্বনি উঠেছে।
ছয় বছর পশ্চিম জার্মান দলের ম্যানেজারির দায়িত্ব পালন করে ফ্রানৎজ বেকেনবাউয়ার বিশ্বকাপ জিতে দায়িত্ব থেকে এবার মুক্তি নিলেন। অধিনায়ক ও কোচ, দুই ভূমিকায় বিশ্বকাপ জয় তাঁর আগে আর কেউ করতে পারেননি। এই বিশ্বকাপের সমাপ্তির সঙ্গে ইংল্যান্ড ম্যানেজার ববি রবসনের দায়িত্বও শেষ হয়ে যায়। টাইব্রেকার পেনাল্টি দ্বৈরথে ইংল্যান্ডের হারের পর তিনি এই পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর মতে : এমন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় পেনাল্টিতে ম্যাচের জয়—পরাজয় নির্ধারণ ঠিক নয়। অতিরিক্ত সময়ের পর আরও পনেরো মিনিট খেলার নিয়ম থাকা দরকার এবং ততক্ষণই যতক্ষণ না কেউ গোল করছে। তাঁর মতে, পেনাল্টি মারার জন্য খেলোয়াড় আলাদাভাবে অন্যায্য চাপের মধ্যে পড়ে অথচ ফুটবল একটা দলগত খেলা। পেনাল্টি মারা শুরু হলে ব্যাপারটা তখন ভাগ্যের হাতে চলে যায়। অপরপক্ষে বেকেনবাউয়ার টাইব্রেকার প্রথা সমর্থন করে বলেন: ১২০ মিনিট খেলার পর নিষ্পত্তির জন্য এর থেকে ভাল পদ্ধতি আর কি হতে পারে? পরাজিতের কাছে ব্যাপারটা দুঃখের কিন্তু খেলাটা তো শেষ করতে হবে। আগে টস করে বিজয়ী নির্ধারিত হতো। সেটা কি খুব ভাল ছিল?
বিশ্বকাপে টাইব্রেকার পেনাল্টি পদ্ধতির প্রবর্তন হয় ১৯৮২ স্পেনে। এখন পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় আটবার এর প্রয়োগ ঘটেছে এবং পশ্চিম জার্মানি দুবার সেমি—ফাইনাল সহ মোট তিনবার এর সঙ্গে জড়িয়েছে ও সফল হয়েছে। টাইব্রেকার সমর্থন করে হ্যাভেলাঞ্জ বলেন : খেলার আইনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল পেনাল্টি এবং সবাই এটা ব্যবহার করে। পশ্চিম জার্মানি ফুটবলের প্রতিটি দিক নিয়ে নিজেদের তৈরি করেছে এবং পেনাল্টিতে সফল হয়েছে। ওরা বিজয়ী হওয়ার উপযুক্ত। অন্য দলগুলিরও তাই করা উচিত।