প্রতি দলেই কয়েকজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড় থাকলেও, সাহসভরে আক্রমণাত্মক হওয়ার বদলে দেখা গেল রক্ষণাত্মক ট্যাকটিকসই খেলাগুলিকে পরিচালিত করেছে। চ্যাম্পিয়নশিপের প্রায় সব ম্যাচে দেখা গেল একই ছক, জয়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা নয়, কি করে হার এড়ান যায় সবার মাথায় যেন সেটাই ঢুকে রয়েছে। তার ফলে বামনাকৃতির দলও দৈত্যদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে খেলার সুযোগ পায়।
১৯৯০ বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতাকে বলা হল, যেন পাস্তা বিনা ইতালিয় ভোজ, যাতে নেই সারবস্তু, নেই বৈচিত্র্য এবং ভোজন শেষে মনে হয় পেটটা যেন খালিই রয়ে গেল। ১৬ জনকে লাল এবং ১৬৯ জনকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে রেফারিরা খেলাকে পরিচ্ছন্ন রাখার যে প্রশংসনীয় চেষ্টা করেন, সেটা শেষপর্যন্ত ফাউল করে খেলার স্নানের সঙ্গে প্রবহমান ফুটবলের শিশুটিকেও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রাজিল তার স্বভাবসিদ্ধ প্রাণোচ্ছলতা পরিহার করে ইওরোপীয় ভঙ্গির আক্রমণ রীতি গ্রহণ করায় লাভ হল এই, দ্বিতীয় রাউন্ডেই তাদের বিদায় ঘটল। প্রচণ্ড গতি আর টিম স্পিরিটের উপর নির্ভর করে ক্যামেরুন, ভবিষ্যদ্বক্তাদের বোকা বানিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। সেখানেও ইংল্যান্ডকে ৮৩ মিনিট পর্যন্ত ২—১ গোলে পিছিয়ে রেখেছিল। অতঃপর গ্যারি লিনেকার পেনাল্টি থেকে গোল দিয়ে ম্যাচটিকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যান এবং আর একটি পেনাল্টি কিক থেকে ইংল্যান্ডকে সেমি ফাইনালে তোলেন। ব্রাজিলের জার্সিপরাদের থেকেও বেশি ব্রাজিলীয় ঢঙে খেলেছে ক্যামেরুন। প্রতিযোগিতার প্রথম ম্যাচেই চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্তিনাকে ১—০ হারিয়ে তারা বিশ্বকাপ ইতিহাসের একটা বড় আপসেট ঘটিয়ে দেয়। অতঃপর রোমানিয়া ও কলম্বিয়াকে হারিয়ে আফ্রিকাকে প্রথমবার বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে স্থাপন করে। প্রথমবার আফ্রিকা দ্বিতীয় রাউন্ডে এসেছিল ১৯৮৬—তে মরক্কোর সৌজন্যে। তবে ক্যামেরুনের উত্থান যতই রূপকথার মত মনে হোক না কেন, কাহিনীসূত্রটা কিন্তু সর্বদা ছোটদের উপযোগী ছিল না। তাদের সাফল্যের অনেকটাই আদায় হয়েছে নির্মমভাবে প্রতিপক্ষকে বাধা দেওয়ার দ্বারা। প্রথম চারটি খেলায়ই তাদের বিরুদ্ধে ১১৫ ফাউল, ১১ হলুদ কার্ড এবং প্রথম ম্যাচেই দুজনকে বহিষ্কারই এর সাক্ষ্য দেবে। প্রতিযোগিতার অপ্রত্যাশিত ‘হিরো’র আবির্ভাব কিন্তু ঘটল এস ক্যামেরুন দলের মধ্য থেকেই, ৩৮ বছর বয়সী রজার মিল্লা। প্রতিযোগিতায় তিনি দ্বিতীয় প্রবীণ ফুটবলার। ভারত মহাসাগরের দ্বীপ লা রিইউনিয়নে এক বছর অবসর যাপনে ছিলেন ও সেখানে অ্যামেচার ফুটবল খেলতেন। ক্যামেরুন প্রেসিডেন্টের অনুরোধে বিশ্বকাপ দলে তিনি স্থান পান। চারটি গোলই তিনি দিয়েছে পরিবর্ত রূপে মাঠে নামার পর। শুধু তাই নয়, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে তিনি মিনিটের মধ্যে মিল্লা তার দলের গোল দুটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। নিখুঁত স্ট্রাইকারের জাত তিন চিনিয়ে দেন এই বিশ্বকাপে। মিল্লার মত ৩৮ বছর বয়সী আর কেউ বিশ্বকাপে কখনও গোল করেননি।
প্রথম রাউণ্ডের গ্রুপ ম্যাচগুলির দমবন্ধ করা, হতাশকর ফুটবলের পর আশা করা গিয়েছিল প্রতিযোগিতা জীবন্ত ও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে দ্বিতীয় রাউণ্ড থেকে। কিন্তু তা হয়নি। আটটি খেলার নির্ধারিত সময়ে হল ১৩ গোল এবং মাত্র তিনটি দল—ইতালি, পশ্চিম জার্মানি ও চেকোশ্লোভাকিয়া—খানিকটা আশাব্যঞ্জক খেলা দেখিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে এগিয়ে যায়।
প্রতিযোগিতা শুরুর আগের ফেভারিট ব্রাজিল ও হল্যান্ডের উচ্চচাকাঙ্ক্ষা চুরমার হওয়ার সঙ্গেই ফুটবল রসিকদের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করার মত বিশ্বকাপ দেখার আশাও দ্রুত বিলীন হতে থাকে। আর্জেন্তিনা এবং মাঝেমধ্যে জ্বলে ওঠা আধাসমর্থ মারাদোনা এমন একটা গর্ত প্রতিযোগিতায় তৈরি করে যেটা ভরাট করা আর সম্ভব হয়নি। সোভিয়েত ‘রেড মেসিন’ ফাঁকা আওয়াজ করে দেশে ফিরে গেল সারাইয়ের জন্য। হল্যান্ড দলে ঈর্ষা করার মত তারকা সমাবেশ ঘটে, রুদ গুলিত, মার্কো ফান বাস্তেন, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড ও রোনাল্ড কোয়েম্যানের উপস্থিতিতে এবং সব থেকে বড় ডিগবাজি খেল হল্যান্ডই। কমলা রঙের জার্সির এই দল আগে মিষ্টিস্বাদের ফুটবল খেলে ইওরোপীয় খেতাব জিতেছিল, তারাই কচলানো পাতিলেবুর মত তেতো হয়ে গেল এই বিশ্বকাপে। গ্রুপের তিনটি ম্যাচ থেকে কোনওক্রমে গলে বেরিয়ে তারা পশ্চিম জার্মানির কাছে ১—২ হারে। প্রতিযোগিতার অন্যতম সেরা খেলা হিসাবে এটি গণ্য হয়। রাইকার্ড ও জার্মানির ফোলার এই ম্যাচে মাঠ থেকে বহিষ্কৃত হন।
তিনবার বল পোস্টে লেগে ফিরে এল এবং সারা ম্যাচে প্রাধান্য রেখেও আর্জেন্তিনার গোলে ব্রাজিল একবারও বল ঢোকাতে পারল না। মারাদোনাতঙ্কে ভোগার জন্য ব্রাজিলের সন্ত্রস্ত ডিফেণ্ডাররা এই লোকটির দিকে বেশি নজর দেওয়ায় ক্লদিও ক্যানিজ্জিয়া যে সুযোগ পান তারই পরিণতিতে একটি গোল এবং আর্জেন্তিনা কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায়। দুটি ম্যাচে, দুটি টাই ব্রেকার এবং মাত্র একটি গোল করে—সেমি ফাইনালে ইতালির বিরুদ্ধে ক্যানিজ্জিয়ার ৬৬ মিনিটের সমতাকারী গোলটি—আর্জেন্তিনা হাজির হয় ফাইনালে। অপরিসীম ভাগ্য সর্বত্রই তাদের অনুসরণ করে না গেলে ফাইনালে ওঠার মত ফুটবল তারা একবারও খেলেনি। ইতালি প্রথম পাঁচটি ম্যাচের প্রতিটিই জিতে ভাগ্যের হাতে মার খেল ষষ্ঠটিতে যখন আর্জেন্তিনা তাদের থেকে ভাল পেনাল্টি শট নিল এবং বাঁচাল। আর্জেন্তিনার নতুন গোলকিপার গয়কোসিয়া দুটি পেনাল্টি শট বাঁচান, ইতালির গোলে ঢোকে চারটি শট, তার মধ্যে একটি ছিল মারাদোনার, প্রতিযোগিতায় তাঁর একমাত্র গোল। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এবারই দুটি সেমি—ফাইনাল খেলারই নিষ্পত্তি হল টাইব্রেকারে। অপরটিতে পশ্চিম জার্মানি—ইংল্যান্ড ম্যাচের ফলও হয় ৫—৪।