কিন্তু পরের রাউণ্ডে ১৬টি দল যখন নকআউট স্তরে মাঠে নামল তখন দেখা গেল অনেক দলই নিজেদের আসল চেহারাটা লুকিয়ে রেখেছিল। স্পেন তার রক্ষণ কাজকে এত কঠিন ও দক্ষতার সঙ্গে বিন্যস্ত করল যে ডেনমার্কের আক্রমণ পা ফেলার জায়গা পেল না। পেনাল্টি থেকে গোল করে এগিয়েও তারা পাঁচটি গোল খেয়ে এবারের মত বিশ্বকাপে তাদের নটে গাছটি মুড়িয়ে ফেলল। এমিলিও বুত্রয়েনো নামে ২২ বছরের সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকারটি চারটি গোল দিলেন। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাসে একটি ম্যাচে চার গোল দেওয়ার এটি অষ্টম ব্যক্তিগত নজির। শেষ এই কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন ২০ বছর আগে ইওসেবিও। বিদায় নিল সোভিয়েত ইউনিয়নও ৩—৪ গোলে গ্রুপ লীগে তৃতীয় স্থান পাওয়া বেলজিয়ামের কাছে হেরে। দম বন্ধ করে দর্শকরা ম্যাচের ভাগ্যের ওঠা—নামা দেখেছেন। ২—২ হবার পর অতিরিক্ত সময়ে বেলজিয়াম করে ৪—৩। সোভিয়েতের বেলানভ প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকটি করেন। ৮৮ মিনিটে কোনক্রমে একটি গোল দিয়ে পশ্চিম জার্মানি হারাল মরক্কোকে। আর্জেন্তিনাও একই ফলে জিতল উরুগুয়ের কাছে। ৬০ বার ফাউলের হুইসল বাজলেও মারাদোনা খুবই পরিণত বোধসম্পন্ন ফুটবল খেললেন এই ম্যাচে। ব্রাজিল ৪—০ গোলে পোল্যাণ্ডকে মুছে দিয়ে বুঝিয়ে দেয় মানুষ ধরে ধরে বিচার করলে এই বিশ্বকাপে তাদের মত প্রতিভাধর দল আর কেউ নেই। ০—২ গোলে হেরে যাবার পর ইতালির ম্যানেজার বেয়ারজোত বললেন, ‘আমরা ওদের মিডফিল্ড প্রতিভার কাছে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।’ ফ্রান্সের মিডফিল্ডে ছিলেন ফার্নান্দ, তিগানা, জিরেস ও ফর্মে ফিরে আসা প্লাতিনি। ইংল্যাণ্ডের ৩—০ গোলে প্যারাগুয়েকে হারানোয় দুটি গোল ছিল লিনেকারের। মেক্সিকোও শেষ আট দলে এল বালগেরিয়াকে ২—০ হারিয়ে।
কোয়ার্টার ফাইনালে চারটি খেলার তিনটি নিষ্পত্তি হয় টাইব্রেকারে। শুধু ৯০ মিনিটেই আর্জেন্তিনা ২—১ গোলে হারিয়েছে ইংল্যাণ্ডকে। এই ম্যাচে অক্লান্ত পরিশ্রমী মারাদোনাকে সূর্যের মত মাঝে রেখে সারা দলটি গ্রহের মত আবর্তিত হয়। গোলদুটি তারই দেওয়া, ইংল্যাণ্ডেরটি লিনেকারের। ৫১ মিনিটে মারাদোনা হেড করতে উঠে হাত দিয়ে গোলে বল পাঠান। তিউনিসিয়ার রেফারি নাসের সেটি গোল হিসাবে গ্রাহ্য করেন। এর চার মিনিট পরই ডানদিকে বল পেয়ে মারাদোনা প্রচণ্ড গতিতে স্টিভেনসকে কাটিয়ে, বুচারকে সম্মোহিত করে, ফেনউইককে পিছনে ফেলে, এবং শিলটনের মত বুদ্ধিমান গোলকীপারকে ধোঁকা দিয়ে যে গোলটি করেন তা সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যক্তিগত গোল হিসাবে গণ্য হয়েছে। ইংল্যাণ্ডের ম্যানেজার ববি রবসন পরে বলেন, ‘আমি ম্যাচের আগেই বলেছিলাম ও পাঁচ মিনিটের মধ্যে জিতে নিতে পারে। আসলে ও ১২ সেকেণ্ডে ৬০ গজের মধ্যে জিতে নিল।’ লিনেকার শোধ দেন একটি গোল। ট্রাইব্রেকারে পশ্চিম জার্মানি ৪—১ মেক্সিকোকে, বেলজিয়াম ৬—৫ স্পেনকে এবং ফ্রান্স ৫—৪ ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে গেল। ব্রাজিল কারেকার দেওয়া গোলে এগিয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে খেলা থেকে বিলীন হতে থাকে। ৪১ মিনিটে প্লাতিনি গোলটি শোধ দেন। ৭৯ মিনিটে মুলারের বদলে জিকো খেলতে নামেন আর তখনই ব্রাজিল পেনাল্টি পায়। ফুটবল দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে জিকো সেই পেনাল্টি থেকে গোল করায় ব্যর্থ হন। ব্রাজিলের জেতা ম্যাচ ট্রাইব্রেকারে ফ্রান্স জিতে নেয়।
সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানি ও আর্জেন্তিনা উভয়েই ২—০ জিতল যথাক্রমে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে। ফাইনালে আর্জেন্তিনার এই তৃতীয়বার ওঠা এবং পশ্চিম জার্মানির রেকর্ড পঞ্চমবার। ফাইনালে জার্মানদের লক্ষ্য ছিল মারাদোনাকে খেলতে না দেওয়া কিন্তু সুইপার ব্রাউন উঠে এসে একটি ফ্রি—কিক থেকে হেড করে ২২ মিনিটে আর্জেন্তিনার প্রথম গোলটি করেন। ৫৭ মিনিটে তারা ২—০ এগিয়ে যায় ভালদানোর গোলে। জার্মানরা দমে না গিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে এবং ৭৪ মিনিটে রুমেনিগে ও ৮২ মিনিটে ফোলার গোল শোধ করেন ব্রেহমের কর্নার থেকে। এরপর জার্মানরা চাপ সৃষ্টি করতে আটজন খেলোয়াড়কে প্রয়োগ করে। খেলা শেষের চার মিনিট বাকি থাকতে বুরুশাগা প্রায় ৩০ গজ ছুটে গিয়ে আগুয়ান গোলকীপার শুমাখারের পাশ দিয়ে গোলে বল পাঠান। ৩—২ জয়ে মারাদোনার কোন গোল নেই বটে কিন্তু জার্মানরা তার খেলা বন্ধ করতে পারেনি। শেষ গোলটি তারই বুদ্ধিদীপ্ত সরবরাহ থেকে বুরুশাগা পেয়েছিলেন। তৃতীয় স্থান পায় ফ্রান্স অতিরিক্ত সময়ে গড়ান খেলায় ৪—২ গোলে বেলজিয়ামকে হারিয়ে।
চূড়ান্ত পর্বে সর্বাধিক গোল দেয় আর্জেন্তিনা— ১৪টি। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চচ গোলদাতা— ইংল্যাণ্ডের গ্যারি লিনেকার—৬টি। ৫২টি ম্যাচে মোট গোল হয় ১৩২।
১৯৯০
ইতালি
১৯ মাসব্যাপী বাছাই পর্বের ৩১৩টি ম্যাচের পর, ইতালিতে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ চূড়ান্ত পর্বের জন্য ২২টি দেশ নির্দিষ্ট হয়। গতবারের বিজয়ী আর্জেন্তিনা ও অনুষ্ঠাতা ইতালিকে বাছাই পর্বে খেলতে হয়নি। ১৯৮৮ এপ্রিলে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো বনাম গুয়ানার মধ্যে ম্যাচটি দিয়ে বাছাই পর্ব শুরু হয় এবং ১৯৮৯ নভেম্বরে শেষ হয় যখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিগুরির শটে ত্রিনিদাদিয়দের চূড়ান্ত পর্বে যাওয়ার আশা ভেঙে, বল গোলে ঢোকে। ক্যালিগুরির শটটি ছিল ১১২টি দেশকে নিয়ে বাছাই পর্বের ৬৯২তম গোল। যুক্তরাষ্ট্র ৪০ বছর পর চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা পায়।