”বিপজ্জনক মানে?” বিষ্টু ধর তাচ্ছিল্য প্রকাশের চেষ্টা করল, কিন্তু গলা দিয়ে বেরিয়ে এল ভয়ার্ত স্বর। ”আমি কি মরে যেতে পারি!”
”তা পারেন। আর নয়তো কেচ্ছসাধনের কষ্ট করতে করতে, রোগে ভুগে ভুগে বেঁচে থাকবেন কয়েকটা বছর।”
বলেই লোকটি দু’ হাত তুলে সামনে ঝুঁকে পিঠটা ধনুকের মত বেঁকাল। হাতের আঙ্গুল পায়ে ছুঁইয়ে আবার সিধে হল।
”আপনি আমার থেকে চার হাজার গুণ বড়লোক, কিন্তু চার লক্ষ টাকা খরচ করেও আপনি নিজের শরীরটাকে চাকর বানাতে পারবেন না।”
”কি রকম! কি রকম!”
লোকটি তার ডান কনুই শরীরে লাগিয়ে পিস্তল ধরার মত হাতটা সামনে বাড়াল।
”এইবার আমার হাতটা নামান তো।”
অবিশ্বাসভরে বিষ্টু ধর হাতটার দিকে তাকাল। শিরা উপশিরা গাঁট সমেত হাতটাকে শুকনো শিকড়ের মত দেখাচ্ছে।
”নামান নামান।”
ফুলো ফুলো আঙুল দিয়ে বিষ্টু লোকটার কব্জি চেপে ধরে নিচের দিকে চাপ দিল। নড়ল না এক সেন্টিমিটারও। ঠোঁট কামড়ে বিষ্টু জোরে চাপ দিল। হাতটা একই জায়গায় রয়েছে। বিষ্টু এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করল। কপালে ঘাম ফুটছে। কিছু লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। তাদের চোখে বিস্ময়, লোকটার সাফল্যে না বিষ্টুর ব্যর্থতায় বোঝা যায় না। বিষ্টু লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে পাতলা হাসি আর চোখ পিটপিটানি দেখতে পেল। হাতটা সে নিচে নামাতে পারছে না। বিষ্টু হাল ছেড়ে দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল।
”কি করে পারলেন!”
”জোরে বলতে শুধু গায়ের জোরই বোঝায় না। মনের জোরেই সব হয়। ইচ্ছা শক্তি দিয়ে শরীরের দুর্বলতা ঢাকা দেওয়া যায়। শরীর যতটা করতে পারে ভাবে, তার থেকেও শরীরকে দিয়ে বেশি করাতে পারে ইচ্ছার জোর। সেজন্য শুধু শরীর গড়লেই হয় না, মনকেও গড়তে হয়। শরীরকে হুকুম দিয়ে মন কাজ করাবে। আপনার মন হুকুম করতে জানে না তাই শরীর পারল না।”
বিষ্টু ধর বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলল, ”ইচ্ছে করে, খুব রোগা হয়ে যাই।”
ঠিক এই সময়ই গঙ্গার তীর থেকে তীক্ষ্ন চীৎকার ভেসে এল, ”কো ও ও ও… নি ই ই ই। কো ও ও ও……নি ই ই ই”
লোকটি গঙ্গার দিকে তাকাল।
।। ২।।
গঙ্গায় একটা আম ভেসে চলেছে ভাঁটার টানে। তিনজন সাঁতরাচ্ছে সেটাকে পাবার জন্য। কোমর জলে দাঁড়িয়ে দু—তিনটি বছর চৌদ্দ—পনেরোর ছেলে জল থাবড়ে হৈচৈ করে ওদের তাতিয়ে তুলছে। সমানে—সমানে ওরা যাচ্ছে। মাথা তিনটে দু’ধারে নাড়াতে নাড়াতে, কনুই না ভেঙে সোজা হাত বৈঠার মত চালিয়ে ওরা আমটাকে তাড়া করেছে।
হঠাৎ ওদের একজন একটু একটু করে এগিয়ে যেতে শুরু করল, অন্য দু’জনকে পিছনে ফেলে। তখনই চীৎকার উঠল—”কো ও ও ও….নি ই ই। কো ও ও ও…নি ই ই ই।” পিছিয়ে পড়া দু’জনও গতি বাড়াল।
আমটা প্রায় প্রথম ছেলেটির মুঠোয় এসে গেছে। হঠাৎ সে থমকে গেল। হাত ছুঁড়ছে কিন্তু এগোল না। বার দুয়েক তার মাথাটা জলে ডুবল। তারপর সে রাগে চীৎকার করে ঘুরে গিয়ে লাথি ছুঁড়ল।
ততক্ষণে পিছন থেকে একজন ওকে অতিক্রম করে আমটা ধরে ফেলেছে।
”পা টেনে ধরেছিল।” বিষ্টু ধর বলল।
লোকটি হেসে চশমাটা খুলে ঝোলায় রাখল। ঘাটের বাইরের দিকে সেখানে কয়েকজন উড়িয়া ব্রাহ্মণদের একজনের কাছে ঝোলাটা রেখে এসে, লোকটি অতি সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। চশমা ছাড়া মনে হচ্ছে, লোকটি যেন অন্ধ।
জলের কিনারে কাদার উপর তখন মারামারি হচ্ছে, একজনের সঙ্গে দু’জনের। কাদা ছিটকোচ্ছে। লোকেরা বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে সরে গেল। দু’—তিনটি ছেলে ওদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।
”ঠিক হ্যায়, চালা, আরো জোরে।”
পা থেকে মাথার চুল কাদায় লেপা কঞ্চির মত সরু চেহারাটা তার লম্বা হাত দুটো এলোপাথাড়ি ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। অন্য দুজন সেই বিপজ্জনক বৃত্তের বাইরে কুঁজো হয়ে তাক খুঁজছে।
”ফাইট কোনি ফাইট। চালিয়ে যা বক্সিং।”
দু’জনের একজন পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। পড়ে গেল দু’জনেই।
”অ্যাই অ্যাই ভাদু চুল টানবি বা কোনির। তাহলে কিন্তু আমরা আর চুপ করে থাকব না।”
কোনির পিঠের ওপর বসা ভাদু, চুল ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে কোনির মাথা ধরে, কাদায় মুখটা ঘষে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। কোনি পা ছুঁড়ল।
কোমরে চাড় দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করল। তারপর ঝটকা দিয়ে ভাদুর ডান হাতটা মুখের কাছে টেনে নিয়ে এসে কামড়ে ধরল দুটো আঙুল।
চীৎকার করে ভাদু লাফিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কোনি উঠে দাঁড়িয়ে ভাদুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
”খুবলে নোব তোর চোখ, বার কর আম। আমাকে চোবানো! পুঁতে রাখব তোকে এই গঙ্গামাটিতে। হয় আম দিবি নয় চোখ নোব।”
দু’হাতের দশটা আঙুল ঈগলের নখের মত বেঁকিয়ে চিত হয়ে পড়া ভাদুর চোখের সামনে কোনি এগিয়ে আনতেই, দু’টি ছেলে ওকে ঠেলে সরিয়ে আনল।
”ছেড়ে দে চন্ডু, হাত ছাড় কান্তি। শোধ নিয়ে ছাড়ব। আমাকে চোবানো?”
কোনির ঠোঁটের কোণে ফেনা, সামনের দাঁত হিংস্রভাবে বেরিয়ে রয়েছে। হিলহিলে লম্বা দেহটা সামনে—পিছনে দুলছে কেউটের ফণার মত।
”এই ভাদু, ও আম কোনির। বার করে দে। নয়তো সত্যিই চোখ তুলে নেবে কিন্তু!”
ভাদু ডান হাতটা চোখের সামনে ধরে দেখছিল। শিউরে উঠে বলল, ”রক্ত বেরোচ্ছে! দাঁত বসিয়ে গত্তো করে দিয়েছে।”