”তবলা বাজা।”
মালিশওলা দশ আঙুল দিয়ে বিষ্টুর গলা থেকে কোমর অবধি ধপাধপ চাঁটাতে শুরু করল। চোখ বুঁজে প্রবল আরামে নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে তার মনে হল, লোকটা নিশ্চয় এখন ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে। বিষ্টু তখন খুবই বিরক্ত বোধ করে বলল, ”সারেগামা কর।”
মালিশওলা নির্দেশ পেয়েই আঙুলগুলো দিয়ে হারমোনিয়াম বাজাতে লাগল বিষ্টুর সর্বাঙ্গে। আঙুলগুলো শরীরে কিলবিল করায় সুড়সুড়ি লাগছিল এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় চর্বি থলথল করে কেঁপে উঠতেই বিষ্টু শুনল খুকখুক হাসির শব্দ।
চিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষ্টু বলল ”এতে হাসির কি আছে, য়্যা?”
সেকেন্ড কুড়ি পর বিষ্টু জবাব শুনল, ”ম্যাসেজ হচ্ছে না সঙ্গীতচর্চা হচ্ছে?”
”যাই হোক না তাতে আপনার কি?”
”ব্লাডপ্রেশারটা মেপেছেন?”
”আপনার দরকার?”
”ব্লাড শু্যগার পরীক্ষা করিয়েছেন? কোলেসটেরল লেভেলটাও দেখেছেন কি?”
‘কে মশাই আপনি, গায়ে পড়ে এত কথা বলছেন। চান করতে এসেছেন, করে চলে যান।”
”তা যাচ্ছি। তবে আপনার হার্টটা বোধহয় আর বেশিদিন এই গন্ধমাদন টানতে পারবে না।”
”কি বললেন!”
বিষ্টু ধর উঠে বসার জন্য প্রথমে কাত হয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথাটা তুলল। তারপর দু’হাতে মেঝেয় চাপ দিয়ে উঠে বসল।
লোকটি কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”অবশ্য হাতি কিংবা হিপোর কখনো করোনারি অ্যাটাক হয়েছে বলে শুনিনি, সুতরাং আমি হয়তো ভুলও বলতে পারি।”
বিষ্টু ধর রাগে কথা বলতে পারছে না, শুধু চোখ দিয়ে কামান দাগতে লাগল। লোকটি পাঞ্জাবি খুলল। লুঙ্গি খুলল। ভিতের হাফ প্যান্ট।
অবশেষে বিষ্টু ধর কোনক্রমে বলল, ”আপনাকে যে কি বলব ভেবে পাচ্ছি না।”
”আমার বৌও ঠিক এই কথাই বলে।”
”আপনি একটা ন্যুইসেন্স।’
”আমার ক্লাবের অনেকে তাই বলে।”
”আপনার মত লোককে চাবকে লাল করা উচিত।”
লোকটি আবার ছেলেমানুষের মত পিটপিট করে তাকাল।
”আচ্ছা, আমি যদি আপনার মাথায় চাঁটি মারি, আপনি দৌড়ে আমায় ধরতে পারবেন?”
কথাগুলো বলেই লোকটি এক জায়গায় দাঁড়িয়েই ছোটার ভঙ্গিতে জগিং শুরু করল। অনেকে তাকাল, অনেকে ভাবল পাগল।
বিষ্টু হতভম্ব হয়ে লোকটির জগ করা দেখতে লাগল। চাঁটি মারার ভঙ্গিতে হাতটা তুলে লোকটি হঠাৎ বিষ্টুর দিকে ছুটে এল। বিষ্টু ডুব দেবার মত মাথাটা নিচু করল। লোকটি হাত তুলে রেখেই পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
”পারবেন ধরতে যদি চাঁটিয়ে যাই? আমার কিন্তু আপনার থেকে অনেক বয়েস।”
জগ করতে করতে লোকটি আবার এগিয়ে আসছে। বিষ্টু ধর বুনো মোষের মত তেড়েফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল। তাইতে লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নাচের ভঙ্গিতে শরীরটাকে পেন্ডুলামের মত ডাইনে এবং বামে দুলিয়ে তিড়িং তিড়িং লাফালাফি শুরু করল। বিষ্টু থাবার মতো দুটো হাত তুলে অপেক্ষা করছে। দৃশ্যটা অনেককে আকৃষ্ট করল।
”আমি রোজ একসারসাইজ করি। আইসোমেট্রিক, ক্যালিসথেনিক, বারবেল, বুঝলেন রোজ করি। দারুণ খিদে পায়। আপনার পায়?”
বিষ্টু ধর কথা না বলে শুধু ঘোঁৎ’ ধরনের একটা শব্দ করল।
”খিদের মুখে যা পাই তাই অমৃতের মত লাগে, এই সুখ আপনার আছে?”
উত্তরের অপেক্ষা না করেই লোকটি জগ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে শেষ ধাপ পর্যন্ত গিয়ে আবার উঠে এল।
তিনবার এইভাবে ওঠানামা করে সে বিষ্টু ধরের পাঁচ গজ তফাতে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। হাত দুটো নামিয়ে বিষ্টু তখন খানিকটা দিশাহারার মতই লোকটির কাণ্ড দেখছিল। ওর চোখে এখন রাগের বদলে কৌতূহল। মনে মনে সে ছিপছিপে শরীরটার সঙ্গে নিজের স্থূলত্ব বদলাবদলি করতে শুরু করে দিয়েছে।
”খাওয়ায় আমার লোভ নেই। ডায়টিং করি।” ভারিক্কি চালে বিষ্টু ধর ঘোষণা করল এবং গলার স্বরে বোঝা গেল এর জন্য সে গর্বিত।
লোকটি দু’পা এগিয়ে এসে বলল, ”কি রকম ডায়টিং!”
”আগে রোজ আধ কিলো ক্ষীর খেতুম, এখন তিনশো গ্রাম খাই; জলখাবারে কুড়িটা নুচি খেতুম এখন পনেরোটা; ভাত খাই মেপে আড়াইশো গ্রাম চালের, রাতে রুটি বারোখানা। ঘি খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, গরম ভাতের সঙ্গে চার চামচের একবিন্দুও বেশি নয়। বিকেলে দু’ গ্লাস মিছরির সরবত আর চারটে কড়াপাক। মাছ—মাংস ছুঁই না, বাড়িতে রাধাগোবিন্দ বিগ্রহ আছে। আর হপ্তায় একদিন ম্যাসেজ করাই এখানে এসে। আমার অত নোলা নেই, বুঝলেন, সংযম কেচ্ছাসাধন আমি পারি। হাটের ব্যামো—ফ্যামো আমার হবে না, বংশের কারো হয়নি। বাজি ফেলে সত্তরটা ফুলুরি খেয়ে কলেরায় বাবা মারা গেছে, জ্যাঠা গেছে অম্বলে।”
”এত কেচ্ছাসাধন করেন! বাঁচবেন কি করে?”
লোকটি এগিয়ে এসে বিষ্টু ধরের ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিল।
”আঃ, সুড়সুড়ি লাগে,” বিষ্টু হাতটা সরিয়ে দিয়ে ক্ষুণ্ণস্বরে বলল, ”আমার বৌও ওই কথা বলে। সকাল থেকে রাত অবধি ব্যবসা দেখি। সর্ষে, চিনি, ডাল নানান জিনিসের কারবার। এত খাটুনির পর এইটুকু খাদ্য! তারপর এই অপমান।”
”কে করল?”
লোকটি আবার হাত বাড়াতেই বিষ্টু একপা পিছিয়ে বলল, ”না, সুড়সুড়ি লাগে।”
”কে অপমান করল?”
”কেন, আপনি হাতি—হিপো বললেন না! জলহস্তির ইংরিজি হিপো তা কি আমি জানি না, আমি কি অশিক্ষিত?”
”না না, আমি আপনাকে অশিক্ষিত তো বলিনি।” লোকটি বিব্রত হয়ে চশমা মুছতে মুছতে বলল, ”আপনার ওজনটা খুব বিপজ্জনক হার্টের পক্ষে।”