মতি নন্দী বাংলা তথা ভারতের খেলার জগতকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতেন। সেইসব কাহিনি নিয়ে লিখেছেন এবং সেইসব রচনাকে সত্যিকারের সাহিত্যমূল্য দিতে পেরেছেন। আমার মনে আছে, ‘স্ট্রাইকার’ উপন্যাসটি পড়ে আমি খুব কেঁদেছিলাম, ‘কোনি’ পড়েও চোখের জল ফেলেছি, তা আনন্দের অশ্রু। কারণ, মতি এই গল্পের ছেলেমেয়েদের শেষপর্যন্ত হারতে দেননি, তাদের জিতিয়ে দিয়েছেন। ছোটদের রচনায় মতি নন্দী অত্যন্ত সহৃদয় একজন মানুষ। কোথাও বিন্দুমাত্র তিক্ততা নেই, আছে আশার উদ্দীপনা। তাঁর অন্যান্য অনেক ছোটদের রচনা পড়েই আমার চক্ষু সজল হয়ে এসেছে।
বড়দের রচনার জন্যও মতি নন্দী একালের একজন অগ্রগণ্য লেখক। আর ছোটদের রচনাতেও সেই লেখকই সার্থক হতে পারেন, যাঁর লেখা ছোটদের সঙ্গে বড়োরাও সমান আগ্রহ নিয়ে পড়ে। যেমন, সুকুমার রায় তো আর শুধু শিশুপাঠ্য নয়, সর্বজনপাঠ্য। আনন্দমেলায় প্রতি বছর আমি মতি নন্দীর উপন্যাসই প্রথম পড়েছি। শেষ কয়েক বছরে তাঁর লেখা না পেয়ে আমি হতাশ হয়েছি। খেলার জগৎ নিয়ে এমন সার্থক রচনা মতি নন্দীর আগে বাংলা ভাষায় আর কেউ লিখতে পারেননি। এবং এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কোনি
কোনি – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস
।। ১।।
আজ বারুণী। গঙ্গায় আজ কাঁচা আমের ছড়াছড়ি।
ঘাটে থৈ থৈ ভীড়। বয়স্কদের ভীড়টাই বেশি। সদ্য ওঠা কাঁচা আম মাথার উপর ধরে, ডুব দিয়ে উঠেই ফেলে দিচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে আম। কেউবা দূরে ছুঁড়ে ফেলছে।
ছোট ছোট দলে ছেলেরা জলে অপেক্ষা করে আছে আম সংগ্রহের জন্য। কেউ গলাজলে দাঁড়িয়ে, কেউবা দূরে ভেসে রয়েছে। আম দেখলেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। একসঙ্গে দু—তিনজন চীৎকার করতে করতে জল তোলপাড় করে এগিয়ে যায়। যে পায়, প্যান্টের পকেটে রেখে দেয়, পকেটটা আমে ভরে গিয়ে ফুলে উঠলে, জল থেকে উঠে ঘাটের কোথাও রেখে আসে। সেই আমে হাত দেয়ার সাধ্য কারুর নেই। পরে আমগুলো ওরা বিক্রি করে পথের ধারে বসা বাজারে, অনেক কম দামে।
আজ গঙ্গায় ভাঁটা, জল অনেকটা সরে গেছে ঘাট থেকে। সিঁড়ি এবং তার দু’ধারে ইঁট বাঁধানো ঢালু পাড় শেষ হয়ে কিছুটা পলিমাটি, তারপর জল। স্নান করে, কাদা মাড়িয়ে বিরক্ত মুখে উঠে আসতে হচেছ। তারপর অনেকে যায় ঘাটের মাথায়, ট্রেন লাইনের দিকে মুখ করে বসা বামুনদের কাছে, যারা পয়সা নিয়ে জামাকাপড় জমা রাখে, গায়ে মাখার সর্ষে বা নারকোল তেল দেয় এবং কপালে চন্দনের ছাপ আঁকে। রাস্তার একধারে বসা ভিখারীদের অনেকে উপেক্ষা করে, কেউ কেউ করে না। দু’ধারের ছোট ছোট নানান দেবদেবীর দুয়ারে এবং শিবলিঙ্গের মাথায় ঘটি থেকে গঙ্গাজল দিতে দিতে, কাঠের, প্লাস্টিকের, লোহার, খেলনার ও সাংসারিক সামগ্রীর দোকানগুলির দিকে কৌতূহলী চোখ রেখে অধিকাংশই বাড়ির দিকে এগোবে। পথের বাজার থেকে ওল বা থোড় বা কলম্বা লেবু ধরনের কিছু হয়তো কিনলেও কিনতে পারে। তারপর, রোদে তেতে ওঠা রাস্তায় খালি—পা দ্রুত ফেলে বাড়ি পৌঁছবে বিরক্ত মেজাজে।
তেলচিটে একটা ছেঁড়া মাদুরে উপুড় হয়ে বিষ্টুচরণ ধরও ডলাই—মালাই করাতে করাতে বিরক্ত মুখে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। বিষ্টু ধর (পাড়ায় বেষ্টাদা) আই. এ. পাশ, অত্যন্ত বনেদী বংশের, খান সাতেক বাড়ি ও বড়বাজারে ঝাড়ন মশলার কারবার এবং সর্বোপরি সাড়ে তিনমণ একটি দেহের মালিক। ওরই সমবয়সী চল্লিশ বছরের একটি বিশ্বস্ত অস্টিন সর্বত্র ওকে বহন করে।
বিষ্টু ধরের বিরক্তির কারণ, হাত পনেরো দূরের একটা লোক। পরনে সাদা লুঙ্গি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে রঙিন ঝোলা। তার দিকে পিট পিট করে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে। বিষ্টু বুঝতে পেরেছে, লোকটা হাসছে তার দেহের আয়তন দেখে। এরকম হাসি বাচ্চচা ছেলেরাও হাসে। বিষ্টু তখন দুঃখ পায়, তার ইচ্ছা করে ছিপছিপে হতে।
কিন্তু বিষ্টু বিরক্ত হচ্ছে যেহেতু এই লোকটা মোটেই বাচ্চচা নয়। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। নুন আর গোলমরিচের গুঁড়ো মেশালে যেমন দেখায়, মাথার কদমছাঁট চুল সেই রঙের। বয়সটা পঞ্চাশের এধারে বা ওধারে বছর পাঁচেকের মধ্যে হতে পারে। লোকটার গায়ের রঙ ধুলোমাখা পোড়ামাটির মত; আর চোখের চাহনি! ধূসর মণি দুটো দেখলে মনে হবে বোধহয় সূর্যের দিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে তাকিয়ে থেকেই মণির কালো রঙটা ফিকে হয়ে গেছে। চাহনিটা এমন, দেখলে মনে হয় যেন তার মনের সঙ্গে মেলে না সেইসব ব্যাপারগুলো ব্লোটর্চের মত পুড়িয়ে দিয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে যাবে। চোয়াল দুটোকে শক্ত করে ধরে আছে জেদ।
মালিশওলা ডান হাঁটুটা বিষ্টুর কোমরে চেপে ধরে মেরুদণ্ড বরাবর ঘাড় পর্যন্ত দ্রুত ওঠানামা করাতে লাগল। পিস্টনের মত। বার দশেক এইভাবে হাঁটু ব্যবহারের পর মালিশওলা নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতের তালু জোড়া করে বিষ্টুর পিঠে জোড়াতালুর কোদাল চালাল।
এরপর বিষ্টু চিত হবার চেষ্টা করল। পারছিল না, মালিশওলা ঠেলেঠুলে গড়িয়ে দিতেই সে অভীষ্ট লাভ করল। আব্রুরক্ষাকারী গামছাটি ঠিকঠাক করে বিষ্টু গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিল, ”তানপুরো ছাড়।”
মালিশওলা দশ আঙুল দিয়ে বিষ্টুর সারা শরীরের চর্বিগুলো খপাখপ খামচে টেনে টেনে ধরে ছেড়ে দিতে লাগল।