ভেলো পাশে এসে দাঁড়াল।
”ভেলো, কি করি এখন বল তো রে। একেবারেই বেকার হয়ে গেলুম।”
”এবার প্রজাপতিকে বরং দেখাশুনো করো। বৌদি একা মেয়েমানুষ, অন্যরাও মেয়ে, পুরুষমানুষ একজন থাকা দরকার। কখন কি মুশকিলে ওরা পড়ে যাবে তার ঠিক কি!”
”তোর বৌদি মানুষটি ছোট্টখাট্ট, কিন্তু আমার থেকে দশগুণ লম্বা কাজের বেলায়। প্রজাপতিতে দারোয়ানি ছাড়া আমায় দিয়ে আর কোন কাজ হবে না।”
”তাহলে?”
ক্ষিতীশ আবার জলের দিকে তাকিয়ে রইল।
”ক্ষিদ্দা, যদি রাগ না করো তো একটা কথা বলি।”
ক্ষিতীশ মুখ ফেরাল।
”তুমি অ্যাপোলোয় চলো।”
”না, ওরা জুপিটারের শত্রু। কতকগুলো স্বার্থপর লোভী মূর্খ আমায় দল পাকিয়ে তাড়িয়েছে বলে শত্রুর ঘরে গিয়ে উঠব?”
”কিন্তু ওখানে তুমি জল পাবে, শেখাবার ছেলেমেয়ে পাবে, কাজ চাইছ কাজ পাবে। অপমানের শোধ তোমায় নিতে হবে। শত্রু—মিত্র বাছবিচার করে কি লাভ?”
ক্ষিতীশ বিব্রতমুখে চুপ করে রইল। তার মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে সেটা তাকে এই মুহূর্তে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে দিচ্ছে না। জুপিটারের সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক, কিন্তু সাঁতারু তৈরী করা তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, ব্রত। লক্ষ্যপূরণ করতে হলে নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে বেরোতেই হবে। কিন্তু তা কি সে পারবে? ক্ষিতীশ মাথাটা ঝাঁকালো।
”তাহলে হেদো কিংবা গোলদিঘির কোন ক্লাবে চলো।”
”কোথাও গিয়ে আমি টিকতে পারবো না রে।” ক্ষিতীশ হাঁটতে শুরু করল একটু জোরেই।
”চুপচাপ বসে থাকবে?” ভেলো হ্যাঁচকা দিয়ে প্যান্ট টেনে তুলে ক্ষিতীশের পাশাপাশি থাকার জন্য প্রায় ছুটতে শুরু করল।
”আমি এবার সত্যিকারের কাজ করতে চাই। সবাইকে দেখিয়ে দেব একবার। চ্যাম্পিয়ন তৈরী করব আমি। গড়ব আমি মনের মতো করে। একবার, শুধু একবার যদি তেমন কারুর দেখা পাই।”
মাথা নীচু করে ক্ষিতীশ হনহনিয়ে কমলদীঘির গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তার ভিড়ে মিশে গেল। ভেলো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গেটের পাশে দাঁড়ানো আলু কাবলিওলাকে বলল, ”জাস্তি ঝাল দিয়ে চার আনার বানাও।”
।। ৪ ।।
সকাল আটটা প্রায়।
ক্ষিতীশ বাজার করে ফিরছে। জুপিটারে আর সে যায় না। সকাল—বিকাল এখন তার কোন কাজ নেই। অবশ্য বাজার করাটা তার নিত্যদিনের কাজগুলির অন্যতম। সে বাজারে যায় বাড়ির কাছের বস্তির সরু গলি দিয়ে, ফেরে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুতে চিলড্রেনস পার্কটাকে ঘুরে অন্য পথ ধরে।
আজ ফেরার পথে দেখল পার্কে খুব ভীড়। বিশ্রাম চালাটায় টেবল চেয়ার পাতা। লাউডস্পীকারে বালক সঙ্ঘের উদ্যোগে কুড়ি ঘণ্টা অবিরাম ভ্রমণ প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কাল রাত আটটায়। শেষ হবে আজ বিকেল চারিটায়।”
লাউডস্পীকারে অন্য একটা চাপা গলা শোনা গেল: ”এই শালা, চারিটায় কি রে বল চারি ঘটিকায়। অ্যালাউনস করতে হলে শুদ্ধু করে বলতে হয়।”
”যা লেখা আছে তাই তো পড়ছি।”
”দে দে, আমাকে মাইক দে।”
এরপর অন্য এক কণ্ঠে শোনা গেল: ”প্রতিযোগিতা শুরু হইয়াছে কল্য রাত্রি আট ঘটিকায়, উদ্বোধন করেন অতীতদিনের খ্যাতকীর্তি ফুটবল খেলোয়াড় শ্রীকৃষ্ণপ্রসাদ মাইতি। পতিযোগিতা সমাপ্ত হইবে অদ্য বৈকাল চারি ঘটিকায়। পুরস্কার বিতরণ করিবেন সদ্ধেয় জননেতা ও আমাদের সঙ্ঘের প্রধান পিষ্টপোষক শ্রীবিষ্টুচরণ ধর মহাশয়। পতিযোগিতায় নেমেছিল বাইশজন পতিযোগী, আটজন অবসর নিয়েছে ইতিমধ্যে।”
ক্ষিতীশের চোখ হঠাৎ আটকে গেছে কঞ্চির মতো লম্বা, নিকষকালো একটি চেহারাতে।
গোলাকৃতি পার্কটিকে ঘিরে রেলিং। তার থেকে ছয় হাত ভিতরে সিমেন্টের পথটা বেড় দিয়েছে মধ্যস্থলের ঘাসের জমিকে। প্রতিযোগীরা পথ ধরে হাঁটছে ক্লান্ত মন্থরগতিতে। অধিকাংশেরই বয়স ১৬—১৭। বৈশাখের ভয়ঙ্কর রোদ মাথায় নিয়ে তপ্ত সিমেন্টের ওপর ওদের সারা দুপুর হাঁটতে হবে।
পরনে ঢিলে ফুল প্যান্ট, ঢলঢলে বুশ শার্ট, পায়ে হাওয়াই চটি। চুলটা ছেলেদের মত হলেও, ঘাড়ের কিনারে পৌঁছে গেছে। রাস্তার মাঝ থেকে ক্ষিতীশ রেলিংয়ের ধারে সরে এল।
ক্ষিতীশের চোখ অনুসরণ করতে লাগল শুধু একজনকেই। পার্কের মধ্যে শিশু ও বালকদেরই ভীড়। বয়স্করা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে শুধুমাত্র ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রতিযোগীদের চোখে রাত্রি জাগরণ, ক্লান্তি আর ক্ষুধার ছাপ। পার্কের চক্কর প্রায় ৭৫ মিটারের। ওদের কেউ কেউ চেনা লোকেদের দেখে শুকনো হাসছে, দু—চারটে কথা বলছে। গঙ্গায় সাঁতারের সঙ্গী সেই তিনটি ছেলে পার্কের মধ্যে ঘাসের উপর দিয়ে কোনির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ওর সঙ্গে কথা বলল। কোনি হাত নেড়ে ওদের চলে যেতে বলছে। চটিজোড়া খুলে পথের পাশে রাখল। উদ্যোক্তাদের দেওয়া লজেঞ্জস পকেট থেকে বার করে ওদের তিনজনকে দিয়ে, একটা মুখে পুরল। হাঁটতে হাঁটতে সে মুখের কাছে হাত তুলে জলপানের ইশারা করতেই নেতাজী বালক সঙ্ঘের একজন ছুটে গিয়ে তাকে এক গ্লাস জল দিয়ে এল। তিন—চার চক্করের পর আবার সে চটি পরল।
ক্ষিতীশের হুঁশ ফিরল যখন তার প্রতিবেশী অমূল্যবাবু অফিস যাবার পথে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ”কি দেখছেন ক্ষিতীশবাবু, বাঙালীদের ক্রীড়াচর্চা?”
লোকটিকে ক্ষিতীশ একদমই পছন্দ করে না, শুধুই নাটকীয় ঢঙে বাঁকা বাঁকা কথা বলে।