.
শোভাবাজার ইউনিয়নে আমি প্রথম ১৬ জনের মধ্যে রয়ে গেলাম। আনোয়ার আর নিমাই ফার্স্ট টিমে পর পর সাতটা লিগ ম্যাচে খেলল। সাতটাই আমরা হারলাম। ইস্টবেঙ্গল দিল পাঁচ গোল, ইস্টার্ন রেল চার, কালীঘাট দুই, মহামেডান চার, এরিয়ান পাঁচ, স্পোর্টিং ইউনিয়ন দুই, বি—এন—আর তিন। আমরা একটাও গোল দিতে পারিনি।
আনোয়ার সাতটা ম্যাচই পুরো খেলেছে। বিপিনদার অত্যন্ত ফেভারিট হয়ে উঠেছে ও। সাতটা খেলায় শোভাবাজার ২৫ গোল খেয়েছে। আমার ধারণা, স্টপারে আনোয়ার না থাকলে সংখ্যাটা ৫০ হত। প্রমিসিং হিসেবে ওর বেশ নাম হয়ে গেছে এই ক’টা খেলাতেই। নিমাই দুটো ম্যাচ পুরো খেলেছে, বাকিগুলোয় আধা আর সিকি।
নিমাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। দু’জন তিনজনকে কাটিয়ে গোলের মুখে অভ্যাস মতো বল ঠেলে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দ্যাখে কেউ নেই, ওদের ব্যাক কিংবা গোলকিপার বলটা ধরেছে। নিমাই মাঠের চারধারে তাকায়। ওর খেলার ধরন একমাত্র যে বোঝে সে তখন মাঠের বাইরে বেঞ্চ—এ ড্রেস করে বসে আছে। নিমাই যত গোল ওপেন করেছে, তার শতকরা নব্বুইটা থেকে আমি স্কোর করতে পারতামই। দেখতে দেখতে চোখে জল এসে যায়। নিমাই অসহায়ের মতন আমার দিকে যখন তাকায়, মুখ ঘুরিয়ে ফেলি।
আমি জানি, ওরও আমার মতন অবস্থা। আমাকে খেলানো হচ্ছে না অথচ ও চান্স পাচ্ছে, তাতেও ও মরমে মরে আছে। তার উপর নিজের যাবতীয় চেষ্টা বিফল হতে দেখে শেষের দিকে নিমাই আর গা লাগায় না। রাগে আমার সর্বাঙ্গ রি রি করে, যখন দেখি উইংগার কি আর এক ইনসাইড ভুল জায়গায় পাস দেওয়ার জন্য নিমাইকে দাঁত খিঁচোচ্ছে।
আমি আর আনোয়ার ওকে বলেছিলাম, তুই নিজেই গোল কর। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলায় নিমাই তিনবার শান্ত আর নঈমের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে সামনে থঙ্গরাজকে পেয়েও গোল করতে পারেনি। দু’বার বাইরে মারল, আর একবার হাতে তুলে দিল। ”কীরকম যেন হয়ে গেলুম”—নিমাই পরে আমাকে বলে, ”অত বড় একটা চেহারা দু’হাত মেলে এগিয়ে আসছে! ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি মেরে দিলুম।”
আমিও রেগেই জবাব দিলাম, ”আর মিথ্যা কথা বলে সাফাই দিতে হবে না। যা বল পেয়েছিলি, তাতে গোলে ইয়াসিন থাকলেও গোল হয়। তুই বাঙাল, তাই গোল করিসনি। আমি যদি মোহনবাগানকে এভাবে পেতুম, বলাই দে সুদ্ধু গোলে ঢুকিয়ে দিতুম।”
নিমাই একগাল হেসে বলল, ”তার পর দু’দিন উপোস করে প্রায়শ্চিত্তি করতিস।” কিছুক্ষণ পর ও গলা নামিয়ে বলল, ”খেলার পর যখন টেন্টে ডেকে নিয়ে গেল জল খাওয়াবার জন্য, তখন পি. সিনহা আমার নাম, কত দিন খেলছি, কোথায় থাকি জিজ্ঞাসা করল। কেন বল তো?”
”সামনের বছর পরিমল দে—কে বিদেয় করে তোকে আনবে বলে।”
নিমাই অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেল। তার পর বেশ রেগেই বলল, ”মোহনবাগানকে গুনে গুনে তিন গোল দেব তা হলে।”
রাজস্থানের সঙ্গে খেলার আগের দিন নোটিশ বোর্ড—এ টিমের লিস্ট—এ আমার নাম উঠল। তিন দিন ধরে আকাশ মেঘলা। বৃষ্টিও হয়ে গেছে দু’দিন। লিস্ট—এ এগারোজনের নামের মাথায় লেখা ‘ইফ রেইন’। পাঁচজনের নামের পাশে পাঁচটি নাম, তাঁদের মাথায় লেখা ‘ইফ নট রেইন’। আমার নাম ‘ইফ নট রেইন’—এর তালিকায়। ব্যাপারটা একজন বুঝিয়ে দিল। বৃষ্টি পড়লে কারা খেলবে আর না পড়লে কারা খেলবে। আমার নামের পাশে টিকাদারের নাম। যদি বৃষ্টি পড়ে তা হলে আমি বাদ, টিকাদার খেলবে।
রাতে ঘুমোতে পারলাম না। ঘন ঘন জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম। তারা দেখা যায় না, ঘোলাটে গঙ্গাজলের মতন আকাশ। কাল বিকেলে বৃষ্টি হবে কি হবে না, ঘেরা মাঠে প্রথম খেলার সুযোগ আসবে কি আসবে না, এই চিন্তা করতে করতে একটা ভয় ক্রমশ আমাকে পেয়ে বসল। কাল নির্ঘাত আমি ওপেন নেট মিস করব। এ রকম আগেও হয়েছে।
.
।।৬।।
চাতরায় একবার ফাইনাল খেলাতে নিয়ে গেছিল পাইকপাড়া অগ্রগামী। সারা রাত চিন্তা করেছিলাম অপোনেন্ট ত্রিবেণী যুব সঙ্ঘের স্টপার আর দুটো ব্যাকের কথা। সেমিফাইনালে চারটে গোল দিয়ে মাঠ থেকে বেরোচ্ছি, তখন যে লোকটি আমায় বলেছিল, ”খোকা, তুমি তো বেশ খেলো! কিন্তু তোমার বাঁ পা যে একদম চলে না!”
পরে শুনলাম তার নাম ‘ল্যাটা মন্টে’। ফাইনালে আমাদের অপোনেন্ট স্টপার। বছর কুড়ি আগে কলকাতা মাঠে খুব নামকরা ফরোয়ার্ড ছিলেন এরিয়ানে। এখন মাঝে মাঝে খেলেন স্টপারে। ওঁর ভাল নামটা কেউ বলতে পারল না। ব্যাক দুটি ক’ মাস আগেই জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমের সঙ্গে এশিয়ান ইয়ুথ চ্যামপিয়নশিপ খেলতে গেছিল ব্যাংকক না সিওল—এ। ওদের সেমিফাইনালের খেলা দেখতে দেখতে পাশের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রাইট ব্যাকটার কী নাম, দাদা?”
”সুধীর কর্মকার। যে রকম খেলছে নাম করবে মনে হচ্ছে।”
ফাইনালের আগের রাতে ঘুমোতে পারিনি, শুধু মাথার মধ্যে অবিরাম গুনগুন করেছে ল্যাটা মন্টের কথাটা, ‘তোমার বাঁ পা যে একদম চলে না’ আর চোখে ভেসেছে সুধীর কর্মকারের ট্যাকলিং। ফাইনালের দিন সকলে ল্যাটা মন্টে আমাদের ঘরে এলেন। ত্রিবেণী টিম পাশের ঘরেই কাল থেকে রয়েছে। আমাদের নীলেদা ওকে দেখেই খাতির করে বসিয়ে বলল, ”মন্টেদা, আজ খেলছেন তো?”
”ভাবছি। শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছে, গঙ্গায় সাঁতার কেটে ফিট না হলে খেলব না। সাঁতারের মতো এত ভাল ‘বডি ফিট’ করার আর কিছু তো হয় না।”