নাকে ভিজে রুমাল চেপে সেই ছেলেটি আমার কাছে এসে দাঁড়াল। ডিগডিগে রোগা, বয়সে আমার থেকে বছর ছয়—সাতের বড় হবে। চোখাচোখি হতেই বলল, ”কোন পজিশনের?”
বললাম, ”স্ট্রাইকার।”
”কোথা থেকে?”
”পাড়ার ক্লাব। এই প্রথম গড়ের মাঠে।”
আনোয়ার হঠাৎ তলপেটে হাত চেপে কুঁজো হয়ে গেল। কেউ হাঁটু দিয়ে মেরেছে। ও অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সামলে উঠল। লক্ষ করলাম, গাঁট্টাগোট্টার দিকে আনোয়ার হিংস্র চোখে তাকাচ্ছে। আমি আঙুল তুলে ছেলেটিকে বললাম, ”আচ্ছা, ওই বেঁটেটার নাম কী?”
”পলাশ টিকাদার। ডেনজারাস ছেলে। গত বছর রেফারিকে চড় মেরেছিল, একজনের পা ভেঙে দিয়েছে, টাকা খেয়ে সেমসাইড গোল করে ম্যাচ হারিয়েছে, টেন্ট থেকে একবার চারটে টেরিলিন ফুলপ্যান্ট একসঙ্গে চুরি করেছে। আমরা ওর থেকে দূরে দূরে থাকি।”
‘আপনার নাকে মারল কে? পলাশ?”
”না, রবি। ছেলেটা ভাল। বিপিনদার ইনস্ট্রাকশন, কী আর করবে।”
লক্ষ করলাম, পলাশ আনোয়ারের থেকে দূরে দূরে রয়েছে। আনোয়ার যতবার ওর পাশে আসছে, ও সরে যাচ্ছে। নিমাই ভিড় থেকে তফাতে।
”আপনি শোভাবাজারে ক’বছর?” আমি কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলাম।
”পাঁচ বছর হবে।”
”ক্লাব বদলাবেন না?”
ওর মুখ ম্লান হয়ে গেল। রক্তমাখা রুমালটা চোখের সামনে অনেকক্ষণ ধরে থেকে বলল, ”বিপিনদা একটা দোকানে কাজ জোগাড় করে দেবে বলেছে।” তার পর রুমালটা মুঠোয় ভরে, ”এইবার নামি” বলে মাঠের দিকে এগিয়ে গেল।
হেডিং প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেছে। এইবার বোধহয় পার্টি করে খেলা হবে। আমি পা থেকে বুট খুলতে শুরু করলাম।
ফেরার সময়ও আসার মতোই কেউ বিশেষ কথা বললাম না। নিমাই একবার বলেছিল, ”মাঠ থেকে উঠে গেলি কেন? এ সব ক্লাবে অত মেজাজ চলে না।” আর একবার বলেছিল, ”পলাশটা মরবে। আনোয়ারকে যা খেপিয়েছে।”
বাড়িতে মা একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ”কী হল?” মন ভাল ছিল না। দায়সারা জবাব দিলাম, ”প্র্যাকটিস হল খানিকটা দম করার জন্য দৌড়োলুম কিছুক্ষণ। প্রথম প্রথম এই সবই চলবে।”
নীলিমা কোনও প্রশ্ন করেনি, তাতে হাঁফ ছেড়েছি। ওর কাছে ফার্স্ট ডিভিশন সম্পর্কে বলে বলে আমি এমন একটা ধারণা করিয়ে দিয়েছি, ময়দানের ঘেরা মাঠ তিনটে যেন দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট আর ঠনঠনের কালীমন্দির; সেই ধারণাটা প্রথম দিনেই ভেঙে দিলে হয়তো ওর চোখে আমি নেমে যাব।
।।৫।।
সন্ধ্যায় হর্ষদার বাড়ি গেলাম। সব শুনে বললেন, ”আরে বিপিন সিংহী যা করতে বলে, করে যাবি। যা গল্প বলবে, শুনে যাবি। ওর কাছে তো খেলা শেখার জন্য তুই যাসনি। গেছিস একটা ফার্স্ট ডিভিশন টিমে ঢুকে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, এরিয়ান কি যুগের যাত্রীর চোখে পড়তে। সে জন্য একটা ক্লাব তো দরকার। শোভাবাজার না হলে তোর মতো অজানা অনামী একটা জুনিয়ারকে চান্স দেবে কে? স্পোর্টিং ইউনিয়ন কি জর্জ টেলিগ্রাফে গেলেও তো পাত্তা পাবি না।”
”চান্স পাবার থেকেও আমি আগে খেলা শিখতে চাই।”
”ম্যাচ খেলাটাও শেখার পক্ষে দরকারি ব্যাপার। এ—বছরটা একটু নাম কর, পরের বছর এরিয়ান কী ভ্রাতৃসঙ্ঘে চেষ্টা করব। বয়স কম রয়েছে, ছোট ক্লাবে দু—তিন বছর থেকে এক্সপিরিয়ান্স তৈরি হলে বরং সুবিধেই হবে বড় ক্লাবে।”
হর্ষদার সঙ্গে তর্ক করা যায় না। একটা না একটা যুক্তি খাড়া করে চুপ করিয়ে দেবেই। ওকে আমার বলতে ইচ্ছে করছিল—দু—তিন বছরই বা নষ্ট করব কেন ছোট ক্লাবে পড়ে থেকে? আমি এখুনি মোহনবাগানে খেলতে চাই। আমার ফেভারিট টিম মোহনবাগান, আমার স্কুলের পুরনো খাতায় খবরের কাগজ থেকে কেটে চুনি গোস্বামীর ছবি পাতার পর পাতায় সেঁটে রেখেছি। মোহনবাগান টেন্টটাকে দূর থেকে তাজমহল ছাড়া আর কিছু ভাবি না।
গোঁড়া ইস্টবেঙ্গলি নিমাই একবার বলেছিল, ওর স্বপ্ন মোহনবাগানের এগেনস্টে হ্যাট্রিক করা। সে দিন থেকে ওর সম্পর্কে এক টুকরো ঘৃণা মনের মধ্যে জমাট বেঁধেছে। বহু সময় সেটাই নিমাইয়ের বিরুদ্ধে আমার রাগে ফেটে পড়ার কারণ হয়। পরে অবশ্য লজ্জা পাই, কেননা আমায় রাগতে দেখলে নিমাই চুপ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। তার পর বলে, ”তোর বড্ড মেজাজ। ভীষণ অধৈর্য তুই।”
আমি জানি, ধৈর্য ধরার মতো মন আমার নেই। সেটা আনোয়ারের আছে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ও খেলে। অত বড় দেহটা বেড়ালের মতো নাড়াচাড়া করায়। ট্যাকল করে বাঘের মতো রোখ নিয়ে অথচ পরিচ্ছন্নভাবে। কেউ ওকে ফাউল করলে, একবার শুধু তার দিকে তাকায়। সাধারণত তার পর আর ফাউল হয় না। সেই তুলনায় নিমাই মিনিটে একটা—দুটো ছোটখাটো ফাউল করে যাবেই। বেশিরভাগই রেফারির চোখের আড়ালে ঘটে। স্টপারটাকে কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছে না, মাঝখানটা এঁটে ধরে আছে, অমনি নিমাই তার পিছনে লেগে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দেখা যাবে, বল ছেড়ে সে নিমাইয়ের পিছু নিয়েছে রাগী মুখে। তার পর আমার কাজ ফাঁকা অঞ্চলটাকে ব্যবহার করা এবং সেটা করেও থাকি।
অসম্ভব ভাল থ্রু দিতে পারে নিমাই, আর বল সমেত টিঙটিঙে শরীরটাকে পাঁকাল মাছের মতো হড়কিয়ে নিয়ে যেতে পারে তিন—চারজন ডিফেন্ডারের মধ্য দিয়ে। ও জানে, আমি কোথায় থাকব। বলটা ঠিক আমার পায়েই ছুটে আসে পোষা কুকুরের মতো। তখন একটা কাজই বাকি থাকে—হয় আলতো করে, নয়তো প্রচণ্ড জোরে বলটাকে গোলের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া। অনেকে বলে, নিমাই না থাকলে আমি গোল করতে পারব না। শুনে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করি, রাগও হয়। কারুর ওপর নির্ভর করে খেলছি, গোল দিচ্ছি, আমার কোনওই কৃতিত্ব নেই—এটা মানতে চাই না। নিমাইকে আমি সত্যিই ঘৃণা করি। কিন্তু ও তা জানে না। ও আমাকে ভালবাসে।