বিপিনদা বোধ হয় আঁচ করতে পেরেছেন যে, কেউ একজন মন্তব্য করেছে। তিনি আন্দাজে আমার দিকে তাকালেন। আমি কাঁটা হয়ে গেলাম।
”ইয়েস, কী যেন বললে?”
আমি রীতিমতো নারভাস হয়ে, কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, তখন পিছন থেকে বলে উঠতে শুনলাম, ”আমি বলছিলুম যে বিপিনদাদের সময়ে মিলিটারিদের সঙ্গে খেলতে হত কিনা, তাই ট্রেনিং, খাওয়াদাওয়া ছিল মিলিটারি ধরনের। তাই শুনে এ বলল, ওইভাবে কুস্তি হয়, ফুটবল খেলা যায় না।”
চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি গাঁট্টাগোট্টার তর্জনী আমার দিকে তোলা এবং মুখটি নির্বিকার সারল্যে ভরা। অনেকে মুখ টিপে হাসছে। আনোয়ার হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ”বাজে কথা, প্রসূন আগাগোড়া চুপ করে আছে। কুস্তির কথা তুমিই বলেছ, আমি পরিষ্কার শুনেছি।”
”কে বলেছে আমি বলেছি?” গাঁট্টাগোট্টা তেরিয়া হয়ে এক পা এগিয়ে এসেই কী ভেবে থমকে গেল। আনোয়ার তার হাফপাউন্ড পাঁউরুটির মতো বাইসেপ দুটো একবার শক্ত করেই আলগা করে দিল। বিপিনদা কিন্তু বেশ খুশি হয়েই বললেন, ‘কারেক্ট, কারেক্ট, ফুটবল খেলতে হলে কুস্তির কিছু কিছু প্যাঁচ জানা দরকার, বিশেষ করে লেঙ্গি মারা।” তার পর আমাদের তিনজনের দিকে লক্ষ করে বললেন, ”তোমরা হর্ষর কাছ থেকে এসেছ?”
আমরা ঘাড় নাড়লাম। উনি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, ”যাও, ও ধারে গিয়ে শট করো। কত দূর মারতে পারো দেখি।”
।।৪।।
যাক, কিছু একটা দেখাবার মতো কাজ প্রথম দিনে পাওয়া গেল! আমি আর নিমাই এক দিকে আর ৬০/৬৫ গজ দূরে আনোয়ার। আনোয়ারের শটের জোর প্রচণ্ড। আনোয়ারের পেনালটি শট আটকাতে গিয়ে এক গোলকিপারের কবজি ভেঙে যায়। শুনেছি শৈলেন মান্নার শটে খুব জোর ছিল। আমি জোর দেখাবার বদলে কেরামতি দেখাতে লাগলাম। আউট সুইং করালাম, চিপ করলাম, ভলি আর সিজারিয়ান মারলাম, দু’—চারবার বাইসাইকেল কিক করার চেষ্টা করলাম, হল না। পেলের ছবি দেখে এটা নকল করার চেষ্টা করেছিলাম। পরে অবশ্য বুঝি, রীতিমতো জিমন্যাসটিকস না জানলে এই শট মারা যায় না। একজন দেখিয়ে দেবার লোকও চাই।
আনোয়ার বিরাট বিরাট শট করে যাচ্ছে। নিমাই কুড়িয়ে আনছে আর গাঁইগুঁই করছে, ”আমি যেন চাকর। কিছু হবে না … শুধু শট করতেই জানে… আমরা বাদ পড়ে যাব প্রসূন, বুঝলি!… আনোয়ারটার স্কিল বলতে তো ঘণ্টা, বিপিনদাকে বল না এবার একটু ট্র্যাপিং, হেডিং, ড্রিবলিং করে দেখাই।”
বিপিনদা অন্য ছেলেদের দিয়ে একই জিনিস করাচ্ছিলেন, লম্বা লম্বা শট। ওঁর কাছে গিয়ে বললাম, ”বিপিনদা, এবার একটু স্কিল প্র্যাকটিস করব?”
”স্কিল!” মনে হল বিপিনদা শব্দটা প্রথম শুনলেন। ”স্কিল? কী করবে তা দিয়ে?”
মাথা চুলকে বললাম, ”মানে, খেলতে গেলে স্কিল ছাড়া তো খেলা যাবে না।”
”শোভাবাজার ইউনিয়নে স্কিল?” বিপিনদার মুখ এমন হয়ে উঠল যেন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে কাউকে জুতো পায়ে ঢুকতে দেখছেন। ”আঠাশটা ম্যাচ খেলে আমরা গতবার সাত পয়েন্ট পেয়েছি, তার আগের বছর পেয়েছিলাম পাঁচ পয়েন্ট। লিগের ওঠা—নামা ছিল না তাই রক্ষে। স্কিল লাগে যারা চ্যামপিয়নশিপ ফাইট করে—মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, যুগের যাত্রী এদের। আমরা ফাইট করি রেলিগেশন, নেমে যাওয়া আটকাতে। স্কিল দিয়ে আমাদের কী দরকার?”
”তা হলে এই যে লম্বা লম্বা কিক প্র্যাকটিস করাচ্ছেন!” আমি অতি বিনীতভাবেই তর্ক করার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করলাম।
বিপিনদা একগাল হেসে বললেন, ”এই হচ্ছে পদ্ধতি, আমার পদ্ধতি। প্রেশারের মধ্যে সব ম্যাচ আমাদের খেলতে হবে। অপোনেন্ট—এর ন’জন আগাগোড়া আমাদের পেনালটি বক্স—এ থাকবে, তখন কী করবে?”
”ক্লিয়ার করব।”
”গুড! গুড! তোমার দেখছি ব্রেন আছে। কিন্তু কীভাবে ক্লিয়ার করবে?”
”কিক করে।”
”ভেএএরি গুড! সেই জন্যই এই লং কিকিং প্র্যাকটিস। এই একটা স্কিলই আমাদের বেশি কাজে লাগে। এর পর গোটা দুয়েক ট্যাকলিং শেখাব, যাও মন দিয়ে এখন বল মারো। তোমার সঙ্গে এসেছে ওই যে ছেলেটা, নাম কী?” বিপিনদা আঙুল তুললেন আনোয়ারের দিকে। নামটা শুনে বললেন, ”গুড প্লেয়ার, স্টপারে ভাল মানাবে।”
বুঝলাম আনোয়ারের চান্স হয়ে গেল। তাতে ভালই লাগল। আমার পোজিশন হল স্ট্রাইকার, আনোয়ার আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।
নিমাইয়ের কাছে গিয়ে বিপিনদার সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে বললাম। শুনে নিমাই বলল, ”আমি মোটেই ঘাবড়াচ্ছি না। লেঙ্গি মারার কায়দা দেখিয়ে চান্স করে নেব। তুই বরং নিজের জন্য ভাব।”
আমি মনে মনে বেশ দমে গেছি। ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবলের সঙ্গে এইভাবে পরিচয় হবে ভাবিনি। ফুটবলের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো জানব, চর্চা করব, তারিফ পাব, অনেক উঁচুতে উঠব, এই সব যা ভাবতাম বিপিনদা তা চুরমার করে দিলেন। আমি গুটিগুটি মাঠের বাইরে এসে বসে পড়লাম। কেউ আমাকে লক্ষ করল না। চারটে বল নিয়ে মাঠে এখন প্র্যাকটিস হচ্ছে হেডিংয়ের। একজন পর পর কর্নার কিক করে যাচ্ছে, গোলের মুখে দশ—বারোজন হেড করে বল বের করে দিচ্ছে। ওরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, হাসাহাসি, গালিগালাজ করছে। একবার হেড করার জন্য সবাই লাফাল, তার পরই একজন নাক চেপে মাঠ থেকে বেরিয়ে এল। কনুই দিয়ে কেউ মেরেছে। আর একবার, গোলকিপার লাফিয়ে উঠে বল—এ হাত দিয়েও ধরল না। কে তার প্যান্টটা এমন জায়গায় টেনে নামিয়ে দিয়েছে যে গোলের থেকে লজ্জা বাঁচানোটাই সে জরুরি কাজ গণ্য করতে বাধ্য হয়েছে।