নিমাই আর আনোয়ার বটতলায় দাঁড়িয়ে। আমি পৌঁছনো মাত্র আনোয়ার হাতঘড়িতে সময় দেখে বলল, ”সাড়ে ছ’টার মধ্যেই পৌঁছে যাব।”
আমরা তিনজনেই যে উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনার শিকার হয়েছি সেটা বোঝা গেল, কেউ আমরা কথা বলতে চাইলাম না। সব থেকে বেশি কথা বলে নিমাই। লোকের পিছনে লাগতে কিংবা কারুর ভঙ্গি বা গলার স্বর নকল করে হাসাতে নিমাই ওস্তাদ। আমাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে শান্তিপল্লি নামে এক জবর—দখল কলোনিতে থাকে। বাবা নেই, দাদার কাপড়ের দোকান আছে হাতিবাগানে। নিমাই ক্লাস ফাইভে ফেল করার পর আর স্কুলে যায়নি।
বন্ধুদের মধ্যে অবস্থা ভাল আনোয়ারের। টকটকে রং, ছ’ ফুট লম্বা, ওজন পঁয়ষট্টি কেজি। একটা হোটেল আর দুটো বস্তির মালিক ওর বাবা। ধীর শান্ত প্রকৃতির আনোয়ারের খেলা তার ব্যবহার এবং জামা—প্যান্টের মতন পরিচ্ছন্ন। এখন পার্ট ওয়ান কমার্স—এর ছাত্র। আমার এবং নিমাইয়ের থেকে বছর তিনেকের বড়। আনোয়ার সঙ্গে থাকলে আমাদের পকেট থেকে একটা পয়সাও বার করতে হয় না। বলা বাহুল্য ওকে ছাড়া আমরা সিকি মাইলও চলি না।
বাসে আমরা শ্যামবাজার পর্যন্ত কেউ একটাও কথা বললাম না। আমার একবার শুধু মনে হয়েছিল, বাবাকেও প্রণাম করলে হত। কিন্তু মনের কোথায় যেন একটা চাপা অভিমান বাবার সম্পর্কে রয়ে গেছে। একদিনও আমাকে খেলার বিষয়ে একটা কথাও বলেননি, একবারও খোঁজ নেননি আমি কেমন খেলছি, আমার খেলা দেখতেও যাননি কখনও। ফুটবল সম্পর্কে বাবার তীব্র ঘৃণা আমি ওঁর ঔদাসীন্যের মধ্য দিয়েই বুঝতে পারি। মা মাঝে মাঝে বলতেন, ‘তোর বাবার কাছ থেকে জেনেটেনে নিস না!’ তারপর বলতেন ‘থাকগে।’ একবার শুধু কানে এসেছিল, মা’র কী একটা কথার জবাবে বাবা বললেন, ”ফুটবল আমাকে ফোঁপরা করে দিয়েছে, খোকাকেও দেবে। ওকে বারণ করো।”
শ্যামবাজার থেকে বাস বদল করে এসপ্লানেডে নামলাম ঠিক সওয়া ছটায়। শোভাবাজার টেন্ট—এ পৌঁছে দেখি জনা বারো ছেলে ড্রেস করায় ব্যস্ত। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, ”বিপিনদা আসবে সাতটায়। আমরা এখন রেড রোড দিয়ে সোজা গিয়ে ট্রাম লাইন পেরিয়ে, প্যারেড গ্রাউন্ডটাকে চক্কোর দেব। ফিরে এসে দেখব বিপিনদা অপেক্ষা করছে।”
ভেবে পেলাম না, এখন আমরা তিনজন কী করব। আনোয়ারই বলল, ”বসে থেকে কী করব, চল ওদের সঙ্গে দৌড়োই। বিপিনদা তাতে ইমপ্রেসড হবে।”
আমরাও ড্রেস করে ওদের সঙ্গে দৌড়ে যোগ দিলাম। মিনিট পাঁচেক দৌড়োবার পর, ওরা প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে না ঘুরে বাঁ দিকে এসপ্লানেড—মুখো হল। তার পর ময়দান হকার্স মারকেট—এ ঢুকে টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে জামায়, মুখে, পায়ে ছিটিয়ে আমাদের দিকে হাসল।
”দাঁড়িয়ে দেখছ কী, গায়ে জল লাগাও। ঘামে জবজব না করলে বিপিনদা খুশি হবে না, আবার ছোটাবে। এবার এখান থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে সোজা টেন্ট—এ।” ওদের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক যে, আমাদের লক্ষ্য করে বলল।
”খবরদার বিপিনদাকে এ সব বলবে না। যদি ফাঁস করো, তা হলে”—গাঁট্টাগোট্টা একজন ভয়ংকর চোখে আমাদের তিনজনের দিকে তাকাল।
আমরা কোনও প্রশ্ন না করে ওদের মতন গায়ে মাথায় জল দিয়ে ‘ঘাম—জবজবে’ হয়ে নিলাম। যেহেতু নতুন, তাই একজন অনুগ্রহ করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল, ”রোজ রোজ এতখানি করে একঘেয়ে দৌড় কি ভাল লাগে? দৌড়ের পরই পার্টি করে খেলা, তার পর পাতলা দু’পিস রুটি আর একটা ডিম। এক মাসেই তো টি বি ধরে যাবে! তাই খাটুনি কমাবার জন্যই এসব করি। বিপিনদা জানতে পারলে কিন্তু রক্ষে নেই, মাঠে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে কুড়ি পাক দৌড় করাবে।” এই বলে সে হাসতে শুরু করল।
”আমরা তো আর চ্যামপিয়নশিপ ফাইট করতে যাব না, নেমেও যাব না, এখন তো রেলিগেশন প্রমোশন বন্ধ। তবে এত দৌড়োবার দরকারটা কী? অফিসের খেলা আছে, খেপের খেলা আছে, এত ধকল কি সামলানো যায়?” আর একজন এই বলে আমাদের যাবতীয় কৌতূহল মিটিয়ে দিল।
প্রথম দিনেই এই রকম রূঢ় ধাক্কায় গড়ের মাঠ সম্পর্কে মোহভঙ্গ হবে আশা করিনি। আমাদের টগবগে উৎসাহ এইখানেই খানিকটা থিতিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ‘এইবার চল রে’ বলে ওরা টেন্ট—এর দিকে আবার দৌড় শুরু করল। আমরাও ওদের পিছু নিলাম।
বেঁটে, টাকমাথা এক প্রৌঢ় মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে। পায়ের কাছে গুটি—চারেক বল। হাফপ্যান্টটা হাঁটুর নীচে ঢলঢল করছে। ভুঁড়ি দেখে মনে হয় গেঞ্জির নীচে আর একটি বল রয়েছে। আমরা দৌড়ে এসে ওঁকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়ালাম। একজন পেটে হাত দিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁফাতে লাগল, একজন শুয়ে পড়ল, আর একজন বলল, ”বিপিনদা যা খাটান, উফ আর পারা যায় না! এবার আমরা মরে যাব।”
বিপিনদার মুখ খুশিতে ঝকমক করে উঠল। কিন্তু যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে বললেন, ”কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে? বড় প্লেয়ার কি অমনি—অমনি হওয়া যায়? তোদের আর কী খাটাচ্ছি, আমরা খেলার দিন আড়াইশো ডন, পাঁচশো বৈঠক আর মাঠে চল্লিশ পাক দিয়ে গুনে গুনে একশো শট মেরে দু’ সের দুধ আর আধ সের বাদাম খেয়ে বাবুঘাটে চলে যেতুম। গঙ্গামাটি মেখে দু’ ঘণ্টা বসে থাকতুম। দুপুরে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে মাঠে নামতুম।”
আমার পিছনে দাঁড়ানো সেই গাঁট্টাগোট্টা ছেলেটি চাপা স্বরে বলল, ”ফুটবল খেলত না কুস্তি করত?”