আমাদের ঘড়ি নেই। নীলিমাকে কাল রাতে বলে রেখেছিলাম ভোর পাঁচটায় ডেকে দিতে। ওর স্কুল সকালে। খুব ভোরে উঠে জল তুলে, উনুন ধরিয়ে বাবার জন্য ভাত রেঁধে ও স্কুলে যায়। আজ সকালে শোভাবাজার ইউনিয়নের মাঠে আমি, নিমাই আর আনোয়ার ট্রায়াল দিতে যাব। হর্ষদা ইউনিয়নের কোচ বিপিন সিংহকে বলে রেখেছেন।
বিছানায় কিছুক্ষণ বসে স্বপ্নের কথা ভাবলাম। ভাবতে ভাবতে লজ্জা পেলাম। এ রকম অবাস্তব উদ্ভট স্বপ্ন যে কেন দেখতে গেলাম ভেবে অবাক লাগল। তবে স্বপ্নে অবাস্তব অকল্পনীয় ব্যাপারই ঘটে। পোর্তুগিজভাষী ব্রাজিলের লোক কিনা বাংলায় কথা বলছে! এমন না হলে আর স্বপ্ন বলা হয় কেন! কিন্তু শুনেছি অকারণে কেউ স্বপ্ন দেখে না; কোনও না কোনও সময়ে যা ভাবি বা মনে মনে পেতে বা হতে ইচ্ছে করে, সেটাই স্বপ্ন হয়ে ফুটে ওঠে।
তা হলে আমি কি পেলে হতে চাই? উফ কী সাহস আমার! ‘পে—এ—লে।’ নামটা খুব নরম স্বরে ফিসফিসিয়ে বার কয়েক উচ্চচারণ করলাম। ওর গল্প হর্ষদার কাছে বহুবার শুনেছি। হর্ষদা ভীষণ বই পড়েন আর খেলা দেখেন, জীবনে কখনও ফুটবল খেলেননি। আগে আমাদের পাড়ায় থাকতেন। ছোটবেলা থেকে আমায় চেনেন। হর্ষদাই প্রথম আমায় বলেন—’প্রসূন, তোমার মধ্যে ফুটবল খেলা আছে, মন দিয়ে খেলো, বড় হতে পারবে।’ কিন্তু পেলে হবার ইচ্ছেটা কখন যে মনের মধ্যে গজিয়ে উঠেছে, সেটা তো একদমই টের পাইনি। আমার ডান পায়ে প্রচণ্ড শট, কিন্তু বাঁ পা ভাল চলে না, বল নিখুঁতভাবে ট্র্যাপ করতে পারি না, হেড করার সময় চোখ বুজে কুঁকড়ে যাই। সবাই বলে বটে আমি খুব স্পিডি আর ভাল ড্রিবলও করতে পারি, কিন্তু সত্তর মিনিট খেলার দম আমার নেই। কখন ফাঁকা জমিতে গিয়ে বলের জন্য অপেক্ষা করব তাও জানি না।
আরও অনেক ঘাটতি আমার আছে অথচ, আমি কিনা পেলে—র জায়গায় খেলার স্বপ্ন দেখছি। আমি যে আস্ত গাড়োল, তাতে সন্দেহ নেই। নিজের ওপর খানিকটা রাগও হতে লাগল। স্বপ্নের কথা যদি নিমাইটা শোনে, তা হলে আমায় নিয়ে হাসাহাসি তো করবেই। দু’ লক্ষ টাকা বছরে! রীতিমতো মাথা খারাপ হলে তবেই এত টাকার কথা কল্পনা করা যায়।
কালও দুপুরে আমরা ছ’ খানার বেশি রুটি কেউ খাইনি, রাত্রে চারখানা। নাড়িভুঁড়ি জ্বলে যাচ্ছিল, তবু রাত্রে পুতুল আর পিন্টুকে আমার থেকে একখানা ছিঁড়ে দু’ ভাগ করে দিয়েছি। মাকে বলে রেখেছিলাম, আমার জন্য আজ সকালে দু’খানা রুটি যেন রেখে দেয়। আজ ট্রায়ালের দিন। একদম খালি পেটে মাঠে নামতে ভরসা হচ্ছে না, যদি ব্যথা খিমচে ধরে। মাকে অবশ্য ট্রায়ালের কথা বলেছি, আর জানে নীলিমাও।
আমার ঘরটা স্যাঁতসেঁতে আর দুপুরেও মনে হয় যেন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অর্ধেক দেয়ালের বালি খসে গেছে, কড়িকাঠে উই, একমাত্র জানলাটার দুটো কপাটেরই কবজা ভাঙা। বৃষ্টি হলে বেশ অসুবিধা হয়। এই ঘরটাকে পুরো—ঘর কোনওভাবেই বলা যায় না। লম্বায় আট ফুট, চওড়ায় পাঁচ ফুট। আমি একা থাকি। একটা টুলও রাখার জায়গা নেই। দেয়ালে তাক আছে। আমার স্কুলের কয়েকটা বই সেখানে পড়ে আছে। দুটো প্যান্ট আর জামা দড়িতে ঝুলছে।
মা ঘরে ঢুকলেন। আমার মা’র মতন মা পৃথিবীতে আর দুটি আছে কি না জানি না। আমাদের এত কষ্টের সংসার, মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায় ক্ষিধেয়, গরমে অপমানে আর হতাশায়। মা’র কিন্তু সব সময় হাসিমুখ। কম কথা বলেন। মিষ্টি মৃদু স্বর শুনলে মনে হয় দুঃখ বলে কোনও জিনিস পৃথিবীতে নেই। মা ঘরে ঢুকেই বললেন, ”খোকা, উঠে পড়েছিস! এখুনি বেরোবি?”
”হ্যাঁ। বাবা উঠেছে?” আমি ঘর থেকে বেরোবার সময় বললাম।
”না, গা—টা কেমন গরম গরম, জ্বর আসবে বোধ হয়। তোর জন্য রুটি রেখেছি।”
মা আমায় চারখানা রুটি দিলেন। আমার বরাবরই মনে হয়, সকলের থেকে মা আমাকেই বেশি ভালবাসেন। রাত্রে নিশ্চয় না খেয়ে আমার জন্য রুটি রেখে দিয়েছেন। অন্য সময় এই নিয়ে রাগারাগি শুরু করে দিতাম, আজ করলাম না। সাতটার মধ্যে মাঠে পৌঁছতে হবে। নিমাই আর আনোয়ার বটতলা বাস স্টপে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে।
বেরোবার সময় মাকে হঠাৎ প্রণাম করলাম। ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে খেলতে যাচ্ছি না, ট্রায়াল দিতে যাচ্ছি মাত্র। যদি বিপিন সিংহের পছন্দ হয়, তা হলে ময়দানের ঘেরা মাঠে খেলার সুযোগ আসবে। ফুটবল আমার কাছে রূপকথার একটা প্রাসাদ। যে আশা মনে মনে বহু দিন ধরে লালন করে আসছি, আজ তার দরজায় পৌঁছোতে যাচ্ছি মাত্র। যদি ঢুকতে পারি, তা হলে এক একটা তলা নীচে ফেলে উপরতলায় উঠবই, উঠতেই হবে। সে জন্য যত পরিশ্রম করা দরকার, করবই। মা আমাকে বুকে চেপে ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তারপর বললেন, ”খোকা, মন দিয়ে চেষ্টা করবি।”
।।৩।।
কিট ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে যখন বটতলার দিকে যাচ্ছি, তখন মনের মধ্যে মা’র কথাটাই গুনগুন করছিল। মন দিয়ে কেন, প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব, মা সারা জীবন কষ্টে কাটিয়েছেন, ওঁকে সুখী করবই। ফুটবলাররা চাকরি পায়, ক্লাব থেকে টাকাও পায়। আমি জানি শোভাবাজার ইউনিয়ন টাকা দেবে না, দেবার সামর্থ্যও নেই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা যুগের যাত্রীতে আমাকে যেতেই হবে। যাবার প্রথম ধাপ শোভাবাজার। এক কী দু’বছরের মধ্যে চোখে পড়াতেই হবে আমার খেলা। খেলা দেখিয়েই বড় ক্লাবে যেতে চাই, তার পর একদিন ইন্ডিয়ার জারসি—ও পরব। টাকা আর খ্যাতি দুটোই আমার চাই, তবে এখন দরকার শেষেরটা।