পরের ম্যাচে যুগের যাত্রীর সামনে পড়লাম আমরা। লিগে যাত্রী এখন সবার উপরে, একটাও পয়েন্ট নষ্ট করেনি। মোহনবাগান হেরেছে ইস্টার্নের কাছে, ইস্টবেঙ্গল ড্র করেছে রাজস্থানের সঙ্গে। এ বছরে পাঁচটা ম্যাচ খেলেছি মাত্র, কিন্তু তাতেই ময়দানের আনাচে কানাচে, অনেক টেন্টে আমাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সামনের বছর কোন ক্লাব আমাকে তুলে নেবে, কত দর হবে, এ সব কথাও নাকি বলাবলি হচ্ছে। লিগের টপ স্কোরার এখন আমি—পাঁচটি ম্যাচে এগারোটা গোল। অসীম মৌলিক দশটা ম্যাচে দশ গোল, অশোক চ্যাটার্জি এগারোটা ম্যাচে আট গোল।
।।১৮।।
নীলিমা স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে সেকেন্ড ডিভিশনে। বাড়িতে হইহই পড়ে গেছে সকালেই। তখনও আমি বিছানা ছেড়ে উঠিনি। বাড়িওয়ালা বিশু দত্ত চেঁচাচ্ছে: ”নুটুবাবু, খাওয়াতে হবে।”
”নিশ্চয় নিশ্চয়, কী খাবেন বলুন!”
”রাবড়ি। বড়বাজারের রাবড়ি।”
ঘরের বাইরে এলাম। দেখি, নীলিমা প্রণাম করছে মাকে। তার পর আমাদের ঘরে ঢুকল। বাবা আছেন ঘরে। মা ফিসফিস করে আমাকে বললেন, ”তোর কাছে টাকা আছে? একটা শাড়ি দিতুম! আহা, কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে।”
”বাবার কাছে নেই?’
”এই মাসটা চালাবার মতন আছে।”
”আমার কাছে টাকা বারো আছে। তাই দিয়ে কি শাড়ি হবে?”
মা ভেবে বললেন, ”থাক তা হলে, পরে দেবখন।”
”জ্যেঠিমা, প্রসূন আমার থেকে কত বড়?” নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, ”ছ’ মাসের বেশি কি?”
মা হেসে বললেন, ”ওই রকমই হবে।”
এর পরই একটা ভয়ংকর অপ্রতিভতার মধ্যে নীলিমা আমাকে ফেলে দিল। গোল থেকে এক গজ দূরে বল পেয়ে গোলের বাইরে মারলে মাঠভর্তি লোকের সামনে যা হয়, সেই রকম বোঁ বোঁ করে উঠল মাথাটা। নীলিমা প্রণাম করেছে আমায়। পাশ করলে দেখছি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়! আমি আমতা আমতা করে কী সব বলতে বলতে ঘরে পালিয়ে এলাম। শুনলাম নীলিমা বলছে, ‘প্রসূন যত মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে, আমি যদি সেভাবে পড়তাম, তা হলে স্কলারশিপ পেতাম।”
উঁকি মেরে দেখলাম, নীলিমা বালতি হাতে কলঘরে যাচ্ছে। ওকে ডাকলাম।
”এবার তো কলেজ?”
”হ্যাঁ। টাকা জোগাড় করতে হবে, প্রায় একশো।”
মনে মনে সিঁটিয়ে গেলাম। যদি এখন এত দিনের ধারের টাকা চেয়ে বসে। তাড়াতাড়ি বললাম, ”তোমাকে কিছু একটা উপহার দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু হাতে এমন টাকা নেই যে কিনতে পারি।”
নীলিমা কিছু বলতে যাচ্ছে, এমন সময় পিন্টু ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকল।
”দাদা, একটা লোক তোমায় ডাকছে। বলল, খুব দরকার।”
গলিতে বেরিয়ে দেখি, রঙিন বুশ শার্ট গায়ে, ফরসা, কটা—চোখ, বছর চল্লিশের একটি লোক দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই খুব পরিচিতের ভঙ্গিতে বলল, ”প্রসূন, একটা কথা ছিল, চলো একটু বাইরে গিয়ে বলব।”
রাস্তায় এসে বললাম, ”যা বলবার এখানেই বলুন, আমি আর যাব না, কাজ আছে।”
একটা ফিয়াট গাড়ি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লোকটা বলল, ”চলো না একটু ঘুরে আসি, মোটরে বসেই বলব। কথাটা খুবই প্রাইভেটলি বলতে চাই।”
লোকটার চালচলন আমার বিশ্রি লাগছে, তার উপর ‘প্রাইভেটলি’ কথা বলার প্রস্তাবটা ভাল লাগল না। বললাম, ”আপনার প্রাইভেট কথা এখানে দাঁড়িয়েও বলতে পারেন, কেউ শুনতে পাবে না।”
লোকটা এধার—ওধার তাকিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”কালকের ম্যাচটা তুমি খেলো না।”
”যাত্রীর সঙ্গে খেলব না?” আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। ”বলছেন কী আপনি!”
”তুমি কত টাকা আর পাও সোনালি থেকে, মাসে মাসে একশো… খবর রাখি, সব ক্লাবেরই খবর রাখি।” লোকটা হঠাৎ পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে আমার হাতটা টেনে মুঠোয় গুঁজে দিল। ”খেলতে চাও যদি, নিশ্চয়ই খেলবে। কুড়ি—পঁচিশ বছর কলকাতায় কোনও বড় ট্রফি আমরা পাইনি, এবার ভাল চান্স এসেছে লিগ পাবার, কাল তুমি ব্যাগড়া দিয়ো না ভাই।”
আমি তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠিনি। বললাম, ‘আমি ব্যাগড়া দেব?”
”ভয় তোমাকেই প্রসূন। কলকাতার সব ক্লাব এখন তোমাকে ভয় করে; মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান সবাই। কাল তুমি গোল দিয়ো না।”
এতক্ষণে আমি সংবিৎ ফিরে পেয়েছি। একশো টাকার নোটটা লোকটার বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, ”এখন থাক। আপনি আমাদের বাড়িতে আসুন, আমার বাবার হাতে এটা দেবেন।”
লোকটা ইতস্তত করে বলল, ”তোমার বাবা কী করেন?”
”বেকার। একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। লক আউট হয়ে বন্ধ।”
”তা হলে তো তোমরা বেশ অসুবিধের মধ্যে রয়েছ।” লোকটা বুকপকেটে হাত দিয়ে বেশ খুশি হয়েই বলল, ”তোমার উচিত সংসারকে হেলপ করা।”
আমি কথা বললাম না। লোকটাকে নিয়ে সটান বাবার সামনে হাজির করলাম। নীলিমা তখন বাবার কাছে বসে কলেজে ভর্তি হওয়ার অসুবিধে নিয়ে কথা বলছে। আমি কোনও ভূমিকা না করে বললাম, ”বাবা, কাল যুগের যাত্রীর সঙ্গে আমাদের খেলা। কাল আমি যেন না খেলি বা খেললেও যেন গোল না দিই, এই কথা ইনি বলছেন আর একশো টাকা আমায় দিতে চাইছেন।”
আচমকা এমন ভাবে বললাম যে, শুধু বাবা আর নীলিমাই নয়, কটা—চোখ লোকটাও আড়ষ্ট হয়ে গেল। অবশেষে বাবা মৃদু স্বরে বললেন, ”কোন ক্লাবের সঙ্গে খেলা?”
”যুগের যাত্রী।” আমি বললাম। মনে হল বাবার চোখ ঝলসে উঠল। ওঁর কপালের উপর আমি অবধারিত চোখ রাখলাম।