কমলের সামনে বল নিয়ে নিমাই থমকে দাঁড়াল। ডাইনে ঝুঁকল, বাঁয়ে হেলল। কমল নিস্পন্দের মতো, চোখ দুটি বলের দিকে স্থির। নিমাই কাকে বলটা দেওয়া যায় দেখার জন্য মুহূর্তের জন্য চোখ সরাতেই ছোবল দেবার মতো কমলের ডান পা নিমাইয়ের হেফাজত থেকে বলটা সরিয়ে নিল।
কমল বল নিয়ে উঠছে। আয়, আয় কে আসবি, গুলোদা, সরোজ, রথীন, রণেন দাস—কোথায় অনুপমের ভক্তরা—আয় কমল গুহর পায়ে বল, আয় দেখি কেড়ে নে।
রাইট হাফকে কাটিয়ে কমল দাঁড়িয়ে পড়ল। সাইড লাইনের ধারের বেঞ্চে রথীন। ওর সুশ্রী মুখটা যন্ত্রণায় মুচড়ে রয়েছে। কমল একবার মুখ ফিরিয়ে রথীনের দিকে তাকিয়ে হাসল। আজও জ্বালাচ্ছি তোদের। বছরের পর বছর আমি জ্বলেছি রে। আমাকে বঞ্চিত করে যাত্রী তোকে ইন্ডিয়ার জার্সি পরিয়েছে, আমাকে প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত করেছে যাত্রী, আমাকে সাধারণ প্লেয়ারের মতো বসিয়ে রেখে অপমান করেছিল…কমল মাঠের মধ্যে সরে আসতেই, দু’জন এগিয়ে এল চ্যালেঞ্জ করতে। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে কমল দু’জনের মধ্যে দিয়ে পিছলে এগিয়ে গেল, বলটা আঠার মতো পায়ে লেগে রয়েছে— অমিতাভর মায়ের মৃত্যুর খবরটা যাত্রী আমাকে দেয়নি রে রথীন। ট্রফি জিততে কমল গুহকে দরকার, তাই খবরটা চেপে গেছল। …আর একজন সামনে এগিয়ে এল কমলের। ডান দিকে সরে যেতে লাগল কমল। বল নিয়ে দাঁড়াল। গোল প্রায় তিরিশ গজ। বলটা আর একটু নিয়ে কমল শট নিল। নিখুঁত মাপা শট। বার ও পোস্টের জোড় লক্ষ্য করে বলটা জমি থেকে উঠে যাচ্ছে। গ্যালারিতে হাজার হাজার হৃদস্পন্দনের শব্দ মুহূর্তের জন্য তখন বন্ধ হয়ে গেল। শ্যাম লাফিয়ে উঠে চমৎকারভাবে আঙুলের ডগা দিয়ে বলটা বারের উপর তুলে দিতেই মাঠের চারধারে আবার নিশ্বাস পড়ল।
কর্নার। শোভাবাজারের আজ প্রথম। যাত্রী পেয়েছে আটটা। তার মধ্যে সাতটাই ভরত লুফে নিয়েছে। বল বসাচ্ছিল দেবীদাস। সত্য ছুটে এসে তাকে সরিয়ে দিল। যাত্রীর ছ’জন গোলের মুখে। শোভাবাজারের পাঁচজনকে তারা আগলে রেখে দাঁড়াল।
সত্য কিক নিল। মসৃণ গতিতে বলটা রামধনুর মতো বক্রতায় গোলমুখে পড়ছিল। গোপাল লাফাল। তার মাথার উপর থেকে পাঞ্চ করল শ্যাম। প্রায় পনেরো গজ দূরে গিয়ে বল পড়ছে। সেখানে দেবীদাস। দু’জন তার দিকে ছিটকে এগোল।
”দেবী!”
বাঁ পাশ থেকে ডাকটা শুনেই দেবীদাস বলটা বাঁ দিকে ঠেলে সরে গেল। পিছন থেকে ঝলসে বেরিয়ে এল একটা চেহারা। তার বাঁ পা—টা উঠল এবং বলে আঘাত করল। বাম পোস্ট ঘেঁষে বলটা যাত্রীর গোলের মধ্যে ঢুকল। এমন অতর্কিত ব্যাপারটা ঘটে গেল যে খেলোয়াড়রা শুধু অবিশ্বাসভরে আঘাতকারীর দিকে তাকিয়ে থাকা কয়েক সেকেন্ড চোখ সরাতে পারল না।
যাত্রীর মেম্বারদের মধ্যে কথা নেই। শুধু একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল মাত্র, ”অত মাংস খাবে কে এবার।”
বিপুল ঘোষ হতভম্ব হয়ে অমিতাভকে বলল, ”য়্যাঁ, যুগের যাত্রী গোল খেয়ে গেল; কে গোলটা দিল?”
অমিতাভ গলার কাছে জমে ওঠা বাষ্প ভেদ করে অস্ফুটে শব্দগুলো বার করে আনল, ”কমল গুহ।” তারপর লাজুক স্বরে যোগ করল, ”আমার বাবা।”
ঝাঁপিয়ে পড়ল যাত্রী শোভাবাজারের গোলে। চার মিনিট বাকি। পরপর তিনটি কর্নার, দু’টি ফ্রি কিক যাত্রী পেল। আব্রাহামের চোরা ঘুষিতে বলাইয়ের ঠোঁট ফাটল। কিন্তু সেই বৃহৎ প্রাচীন অশ্বত্থ গাছটি সব ঝড়ঝাপটা থেকে আড়াল করে রাখল তার পিছনের গোলটিকে।
শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে মাঠের মধ্যে দৌড়ে এল শম্ভু। ”আমি সেরে গেছি, আমি সেরে গেছি কমলদা। আমার আর ব্যথা নেই।”
প্রথম কমলের দুই হাঁটু জড়িয়ে তাকে উপরে তুলল সত্য। তারপর কীভাবে যেন চারটে কাঁধ চেয়ার হয়ে কমলকে বসিয়ে নিল। ইস্টবেঙ্গল মেম্বার গ্যালারি উত্তেজনায় বিস্ময়ে টগবগ করছে।
কাঁধের উপর কমলকে তুলে ওরা মাঠের বাইরে এল। কৃষ্ণ মাইতির গলা ধরে গেছে চিৎকার করে। ”কমল, বল বল, আমি প্লেয়ার চিনি কি না বল। নিজের রিসকে সব অপোজিশন অগ্রাহ্য করে তোকে খেলিয়েছিলুম আগের ম্যাচে, বল ঠিক বলছি কি না।”
কমলের মস্তিষ্ক ঘিরে এখন যেন একটা কালো পরদা টাঙানো। কী ঘটছে, কে কী বলছে তার মাথার মধ্যে ঢুকছে না, কোনও আবেগ বেরোতেও পারছে না। ক্লান্তিতে দু’চোখ ঝাপসা। তার শুধু মনে হচ্ছে, কিছু অর্থহীন শব্দ আর কিছু মানুষ তার চারপাশে কিলবিল করছে। কমল ভারবাহী একটা ক্রেনের মতো নিজের শরীরটা নামিয়ে দিল ভূমিতে। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর টপটপ করে তার চোখ থেকে জল ঝরে পড়ল ঘাসের উপর। কেন পড়ছে তা সে জানে না।
অতি যত্নে তার পা থেকে বুট খুলে দিচ্ছে কে! কমল মাথা ফিরিয়ে দেখল, সলিল। গ্যালারির দিকে কমল তাকাল। একটা পটকাও ফাটেনি। পতাকা ওড়েনি। উৎসব করতে আসা মানুষগুলো নিঃশব্দে বিবর্ণ অপমানিত মুখগুলোয় শ্মশানের বিষণ্ণতা নিয়ে মাঠ থেকে চলে যাচ্ছে। গ্যালারি ক্রমশ শূন্য হয়ে এল। বেদনায় মুচড়ে উঠল কমলের বুক। আর কখনও সে মাঠের মধ্যে থেকে ভরা—গ্যালারি দেখতে পাবে না। কমল গুহ আজ জীবনের শেষ খেলা খেলেছে।
কমল উঠে দাঁড়াল। কোনও দিকে না তাকিয়ে মুখ নিচু করে সে মাঠের মাঝে সেন্টার সার্কেলের মধ্যে এসে দাঁড়াল। আকাশের দিকে মুখ তুলল। অস্ফুটে বলল, ”আমি যেন কখনও ব্যালান্স না হারাই। আমার ফুটবল যেন সারা জীবন আমাকে নিয়ে খেলা করে।”