কিন্তু হাফ টাইমের কয়েক সেকেন্ড আগে শম্ভুর পা থেকে ছিটকে যাওয়া বল পেয়ে গোপাল অভাবিত যাত্রীর গোলের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় আনোয়ার ও অমিয়কে পিছনে ফেলে। গোলকিপার শ্যাম এগিয়ে এসেছে। গোপাল প্রায় চোখ বুজেই শট নেয়। শ্যামের ঝাঁপানো হাতের নাগাল পেরিয়ে বল ক্রসবারে লেগে মাঠে ফিরে এল।
সারা মাঠ বিস্ময়ে হতবাক। অকল্পনীয় ব্যাপার, শোভাবাজার গোল দিয়ে দিয়েছিল প্রায়। বিস্ময়ের ঘোর কাটল রেফারির হাফ টাইমের বাঁশিতে। মাঠের সীমানার বাইরে এসে শোভাবাজারের ছেলেরা একে একে বসে পড়ল। কৃষ্ণ মাইতি জলের গ্লাস আর তোয়ালে নিয়ে ব্যস্ত। প্লেয়াররা কেউ কথা বলছে না। পরিশ্রান্ত দেহগুলো ধুঁকছে। অবসন্নতায় পিঠগুলো বেঁকে গেছে।
কৃষ্ণ মাইতি হাত নেড়ে বক্তৃতা দেওয়ার ঢঙে বলল, ”এবার লং পাসে খেলে যা, শর্ট পাস বন্ধ কর! সত্য, তুই অত নেমে খেলছিস কেন, উঠে খেল। সলিল, আরও রোবাস্টলি খেলতে হবে, বার কয়েক পা চালা, আব্রাহামটা দারুণ ভিতু।”
কমল হাত তুলে কৃষ্ণ মাইতিকে চুপ করতে ইশারা করল, ”এখন ওদের কিছু বলবেন না।”
সলিল বলল, ”কমলদা, ওটা আমারই দোষ ছিল। প্রসূন পাসটা অত আগেই দেবে বুঝতে পারিনি, নয়তো আগেই ট্যাকল করতুম। আপনি না থাকলে গোল হয়ে যেত।”
কমল কথাগুলো না শোনার ভান করে গ্যালারির শেষ প্রান্তে তাকাল। চেষ্টা করল একটা মুখ খুঁজে বার করতে। ব্যর্থ হয়ে বলল, ”অমিতাভ এসেছে কি?”
সলিল বলল, ”হ্যাঁ, ওই তো। ওই যে একজন মেয়েছেলে বসে আছে—ঠিক তার সামনে। বল আনতে গিয়ে আমি দেখেছি।”
কমল আবার তাকাল।
যাত্রীর মেম্বারদের মধ্যে থমথমে ভাব। কেউ কেউ উত্তেজিত। ‘অনুপমের এ কী খেলা!’ ডিফেন্স যখন ক্রাউডেড করেছে তা হলে ওদের টেনে বার করে ফাঁকা করুক।’ ‘প্রসূন নিজে গোলে না মেরে পাস দিতে গেল কেন?’
‘শম্ভুর ট্যাকলিং প্রত্যেকটা ফাউল, রেফারি দেখেও দেখছে না। আব্রাহামকে যে অফসাইডটা দিল দেখেছেন তো?’ ”একবার বল এনেছে তাতেই গোল হয়ে যাচ্ছিল; চলে না, আনোয়ার ফানোয়ার আর চলে না।”
কমল উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল। কানে এল কচি গলায় পিণ্টু ডাকছে, ”কমলমামা, কমলমামা, এই যে আমরা এখানে।”
.
।।আঠারো।।
রেফারি বাঁশি বাজাল।
”মনে আছে তো, শোভাবাজার আজ লড়বে।” মাঠে নামার সময় কমল মনে করিয়ে দিল। ওরা কথা বলল না।
কমল আশা করেছিল যাত্রী ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সাবধানে ওরা মাঝমাঠে বল রেখে খেলছে। মিনিট পাঁচেক কেটে যাবার পর অনুপম বল পেয়ে কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে ছুটে থমকে স্বপনকে কাটিয়ে নিয়ে ঢুকতে গিয়ে কমলের কাছে বাধা পেল। সেন্টার করল সে। ভরত সহজেই আব্রাহামের মাথা থেকে বল তুলে নিল।
”স্বপন, কী ব্যাপার! অনুপম বিট করে গেল?” কমল কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে গেল। আবার অনুপম এগোচ্ছে বল নিয়ে।
স্বপন এবারও পিছনে পড়ে ঘুরে এসে আর চ্যালেঞ্জ করল না। কমল বুঝে গেল স্বপন আর পারছে না। এবং লক্ষ করল, বলাই এবং প্রাণবন্ধুও মন্থর হয়ে এসেছে। সলিলের মধ্যে ক্লান্তির ছাপ এখনও দেখা দেয়নি। শম্ভু মাঝমাঠে দোর্দণ্ড হয়ে রয়েছে। যেখানে বল সেখানেই ছুটে যাচ্ছে। দেবীদাস আর সত্য বল দেওয়া—নেওয়া করে যাত্রীর হাফ লাইন পর্যন্ত বার কয়েক পৌঁছতে পেরেছে।
ফাউল করেছে শম্ভু। যাত্রীর রাইট ব্যাকের বুকে পা তুলে দিয়েছে। সে কলার ধরেছে শম্ভুর। গ্যালারি থেকে কাঠের টুকরো আর ইট পড়ছে মাঠে শম্ভুকে লক্ষ্য করে। এর এক মিনিট পরেই শম্ভুকে মাঠের বাইরে যেতে হল। আব্রাহাম, অমিয় আর শম্ভু এক সঙ্গে বলের উদ্দেশ্যে ছুটে গিয়ে এক সঙ্গেই মাটিতে পড়ে গেল। দু’জন উঠে দাঁড়াল, শম্ভুকে ধরাধরি করে বাইরে আনা হল। এবং মিনিট তিনেক পর যখন সে মাঠে এল তখন খোঁড়াচ্ছে।
মাঝমাঠে এখন যাত্রীর রাজত্ব। শম্ভু ছুটতে যায় আর যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে।
”কমলদা, আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমাকে শেষ করে দিয়েছে। ওদের একটাকে নিয়ে বরং আমি বেরিয়ে যাই।”
”না। তুই বোস। রতনকে নামতে বল।”
”আমি বরং প্রসূনকে নিয়ে—ও ভাল খেলছে।”
”খেলুক। খেলতে হবে ওকে।” কমলের রগের শিরা দপদপ করে উঠল। ”না খেললে কমল গুহকে টপকানো যাবে না।”
শম্ভু বসল এবং তৃতীয় ডিভিশন থেকে এই বছরেই আসা নতুন ছেলে রতন নামল। তখন গ্যালারিতে পটকা ফাটল। যাত্রীর আক্রমণে আট জন উঠে এল এবং ক্লান্ত শোভাবাজার সময় গুনতে লাগল কখন গোল হয়। এবং—
একটা প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের মতো কমল গুহ তখন শোভাবাজারের পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে শাখা বিস্তার করে দিল। কখনও সে বন্য মহিষ কখনও বনবিড়াল, কখনও গোখরো সাপ। শোভাবাজার পেনাল্টি এলাকাটা ভয়ঙ্কর করে তুলল কমল তার ক্রুদ্ধ চতুর হিংস্র বিচরণে। একটার পর একটা আক্রমণ আসছে, প্রধানত সলিলকে নিয়ে কমল সেগুলো রুখে যাচ্ছে। আর গ্যালারিতে অশ্রান্ত গর্জন ক্রুদ্ধ—হতাশায় আর্তনাদে পরিণত হচ্ছে।
এইবার, এইবার যাত্রী, আমি শোধ নেব। কমল নিজের সঙ্গে কথা বলে চলে। আমার মাথা নোয়াতে পারোনি, আজও উঁচু করে বেরোব মাঠ থেকে। গুলোদা, রথীন, এদের সব ব্যঙ্গ সব বিদ্রূপ আজ ফিরিয়ে দেব। বল আনছে প্রসূন, এগোক, এগোক, সলিল আছে। ওর পিছনে আমি। আহ লেফট উইং নিমাইকে দিল, বলাই চেজ করছে, ওর পিছনে আমি আছি।