যাত্রী শুরুতেই ধাক্কা দিয়ে তারপর ক্রমশ এগিয়ে এসে শোভাবাজারের পেনাল্টি এরিয়াকে ছয়জনে ঘিরে ধরল এবং দুই উইং ব্যাকও উঠে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। শোভাবাজারের গোপাল ছাড়া আর সবাই গোলের মুখে নেমে এসেছে। কমল বিপদের গন্ধ পেল। আঠারো জন লোক একটা ছোট জায়গার মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে করতে হঠাৎ কখন কে ফাঁক পেয়ে গোলে বল মেরে দেবে এবং এইরকম অবস্থায় সাধারণত ভিড়ের জন্য গোলকিপারের দৃষ্টিপথ আড়াল থাকে। তা ছাড়া ট্যাকল করার আগে কোনও রকম বিচারবোধ ব্যবহার না করায় এবং যথেষ্ট স্কিল না থাকায় শোভাবাজারের ডিফেন্ডাররাও বেসামাল হতে শুরু করেছে।
এতটা ডিফেন্সিভ হওয়া উচিত হয়নি। কমল দ্রুত চিন্তা করে যেতে লাগল। শুধু গোঁয়ার্তুমি সাহস বা দমের জোরে একটা স্কিল্ড অ্যাটাককে ঠেকানো যায় না। কাউন্টার—অ্যাটাক চাই। বল নিয়ে উঠতে হবে। গোপাল উঠে আছে কিন্তু ওকে বল দিয়ে কাজ হবে না। একা বল নিয়ে দুটো স্টপারকে কাটিয়ে বেরোবার ক্ষমতা ওর নেই। বল আবার ফিরে আসবে।
প্রাণবন্ধুর একটা মিসকিক কমল ধরে ফেলল। সামনেই যাত্রীর আব্রাহাম। কোমর থেকে একটা ঝাঁকুনির দোলা কমলের শরীরের উপর দিয়ে উঠে যেতেই আব্রাহাম টলে পড়ল। বল নিয়ে কমল পেনাল্টি এরিয়া পার হল।
”ওঠ সলিল।”
কমলের পিছনে প্রসূন, অনুসরণ করছে সলিল। কমলের ডাকে সে এগিয়ে এল। যাত্রীর হাফ ব্যাক অমিয় এগিয়ে আসতেই কমল বলটা ঠেলে দিল সলিলকে। দ্রুত শোভাবাজারের চারজন উঠছে। বল ডান থেকে বাঁ দিকে, আবার ঘুরে ডান দিকে এল। শেষপর্যন্ত যাত্রীর কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে রুদ্রর কাছ থেকে বল কেড়ে নিল আনোয়ার।
কমল এগিয়ে এসেছে। প্রায় দশ মিনিট যাত্রীর চাপ তারা ধরে রেখেছিল। খেলাটাকে মাঝমাঠে আটকে রেখে যাত্রীর গতি মন্থর করাতে হবে। কমল বল ধরে পায়ে রাখতে শুরু করল। রুদ্র, সত্য আর দেবীদাস মাঠের মাঝখানে, শম্ভু ঠিক ওদের পিছনে। তার কাছে বল পাঠিয়ে কমল চার ব্যাকের পিছনে পেনাল্টি এরিয়া লাইনের উপর দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে লাগল যাত্রীর কে কোথায় কীভাবে নড়াচড়া করছে।
আঠার মতো লেগে আছে শোভাবাজারের চারটি ব্যাক যাত্রীর চার ফরোয়ার্ডের সঙ্গে। অনুপমের কাছে চার বার বল এসেছে এবং প্রতিবার সে বলে পা লাগাবার আগেই স্বপন ছিনিয়ে নিয়েছে। বল যখন যাত্রীর বাম কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে, অনুপম তখন শোভাবাজারের রাইট হাফের কাছাকাছি ডান টাচ লাইন ঘেঁষে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর পাঁচ হাত দূরে স্বপন। অনুপম হাঁটতে লাগল সেন্টার লাইনের দিকে, ওর পাশাপাশি চলল স্বপনও। অনুপম হঠাৎ ঘুরে আসার আগের জায়গায় ফিরে এল, স্বপনও ওর সঙ্গে ফিরে এল। গ্যালারিতে যাত্রীর সমর্থকরা পর্যন্ত ব্যাপারটা দেখে হেসে উঠল। অনুপম ডানদিক থেকে বাঁদিকে নিমাইয়ের জায়গায় ছুটে গেল, স্বপনও। যতবার বল তার দিকে আসে, স্বপন হয় টাচ লাইনের বাইরে ঠেলে দেয়, নয়তো মাঠের যেখানে খুশি কিক করে পাঠায়। অনুপম দু’বার স্বপনকে কাটিয়েই দেখে, কমল স্বপনকে কভার করে এগিয়ে এসে তার পথ জুড়ে আছে। কী করবে ভেবে ঠিক করার আগে স্বপনই ঘুরে এসে ছোঁ মেরে বলটা নিয়ে গেল।
শম্ভু পাগলের মতো মাঝমাঠটাকে ফালা ফালা করে দিচ্ছে যাত্রীর ফরোয়ার্ডদের উদ্দেশ্যে পিছন থেকে পাঠানো বল ধরার জন্য, ডাইনে—বামে যেখান থেকেই আক্রমণ তৈরি হয়ে ওঠার গন্ধ পেয়েছে, ছুটে যাচ্ছে বুলডগের মতো। সব সময়েই যে সফল হচ্ছে তা নয়, কিন্তু ওর জন্য বল নিয়ে যাত্রীর কেউ সহজে উঠে আসতে পারছে না। যদিও বা ওয়াল—পাস করে উঠে আসে, প্রাণবন্ধু নয় তো সলিল এগিয়ে আসে চ্যালেঞ্জ করতে।
প্রসূন পিছিয়ে নেমে এসেছে। সলিলও তার সঙ্গে যাচিছল, কমল বারণ করল।
”মাঝমাঠে যত ইচ্ছে প্রসূন খেলুক, তুই এখানে থাক! যখনই উঠে আসবে আবার লেগে থাকবি।”
তারপরই যাত্রীর দুই উইং ব্যাক দু’দিক থেকে উঠতে শুরু করল। কমল বিপদ দেখতে পেল। নিমাই, আব্রাহাম আর অনুপম ছোটাছুটি করে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলাই, প্রাণবন্ধু আর স্বপনকে নিয়ে। প্রসূন বল নিয়ে উঠছে, দু’পাশ থেকে উইং ব্যাক দু’জন। কমল দু’দিকে নজর রাখতে লাগল কোন দিকে প্রসূন বল বাড়িয়ে দেয়।
চার ব্যাকের পিছনে মাঝামাঝি জায়গায় কমল দাঁড়াল। প্রসূন দেবীদাসকে কাটাল, শম্ভুর স্লাইডিং ট্যাকল ব্যর্থ হল। সলিল এগোচ্ছে। প্রসূনের বাঁ কাঁধ সামান্য ঘুরেছে গোলের দিকে, এবার ডানদিকে বল বাড়াবে। কমল তার বাঁ দিক চেপে সরে গিয়ে উঠে আসা রাইট ব্যাকের দিকে নজর দিল আর প্রসূন অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শরীর মুচড়ে তার বাঁ দিকে বল পাঠাল, যেখানে লেফট ব্যাক বাঁদিক থেকে ফাঁকায় উঠে এসেছে।
প্রায় পঁচিশ হাজার কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল—গো—ও—ল গো—ও—ল। সেই প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে জ্বালা ধরানো কোনও খবর ছিল না যা কমলের স্নায়ুকেন্দ্রে মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটাল। বাঁ দিকে ঝোঁকা দেহভারকে সে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় ডান দিকে ঘুরিয়ে ছুটে এল লেফট ব্যাকের সামনে। প্রায় ১২ গজ দূরত্ব গোল থেকে। শট নিলে নিশ্চিত গোল। হঠাৎ সামনে কমলকে দেখে সে শট নিতে গিয়েও নিতে পারল না। পলকের মধ্যে কমল বলটা কেড়ে নিয়ে যখন রুদ্রর কাছে পাঠাল তখন গ্যালারির চিৎকার চাপা হতাশায় কাতরে উঠেছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট খেলা হয়ে গেল, এখনও গোল হল না। শোভাবাজার একবারও যাত্রীর গোলের দিকে যায়নি।