‘ফিল্ডমার্শালে’র পিছন পিছন দু’টি চাকর বিরাট এক হাণ্ডা নিয়ে গ্যালারিতে এসেছে। ওতে আছে পনেরো কিলো রান্না করা মাংস। খেলা শেষে ভাঁড়ে বিতরণ করা হবে। হুটোপুটি পড়ে গেল হাণ্ডার কাছাকাছি থাকার জন্য।
”বড় খিদে পেয়েছে দাদা, ব্যাপারটা অ্যাডভান্সই চুকিয়ে ফেলুন না। রেজাল্ট তো জানাই আছে, তবে আর আমাদের কষ্ট দেওয়া কেন?”
”নৌ নৌ। এখন নয়।” ফিল্ডমার্শাল দু’হাত তুলল। ”অফিসিয়াল ভিকট্রির পর।”
মাঠের এক কোনায় গ্যালারিতে রয়েছে শোভাবাজার স্পোর্টিয়ের ডে—স্লিপ নিয়ে যারা এসেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই অবশ্য মনে মনে যাত্রীর সমর্থক। বিপুল ঘোষ আজ প্রথম মাঠে এসেছে কমলের কাছ থেকে স্লিপ নিয়ে। তার পাশেই বসেছে অমিতাভ। চুপচাপ একা। সলিল তাকে স্লিপ দিয়েছে। ফুটবল মাঠে আজই প্রথম আসা। ওদের পিছনে বসে অরুণা আর পিণ্টু। গতকাল কমল গেছল ওদের বাড়িতে; পল্টু মুখার্জির ছবির সামনে চোখ বুজে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, ছবিতে মাথা ঠেকিয়ে সে বিড়বিড় করে কিছু বলে। পিণ্টুও তার দেখাদেখি প্রণাম জানায়। পিণ্টুই বায়না ধরে, কমলমামার খেলা সে দেখবে।
গ্যালারিতে পিণ্টু অধৈর্য হয়ে ছটফট করে, কখন টিম নামবে। অরুণা ছোটবেলায়, পিণ্টুরই বয়সে বাবার সঙ্গে মাঠে এসে দেখেছে কমলের খেলা, শুধু মনে আছে, সারা মাঠ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল কমলকে নিয়ে। আজ তারও প্রচণ্ড কৌতূহল। বিপুল ঘোষ ঘড়ি দেখে পাশের অমিতাভকে বলল, ”খেলা ক’টায় আরম্ভ বলতে পারেন?”
অমিতাভ মাথা নাড়ল। শোভাবাজারকে কতকটা বিদ্রূপ জানাতেই প্রচণ্ড শব্দে মাঠের মধ্যে পটকা পড়ল, তারপর পিণ্টু প্রবল উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ”ওই যে কমলমামা।”
.
কয়েকদিন ধরে কমল বারোটি ছেলেকে নিয়ে রীতিমতো ক্লাস করেছে তার শোবার ঘরে। মেঝেয় খড়ি দিয়ে মাঠ এঁকে, তার মধ্যে ঢিল সাজিয়ে (ঢিলগুলি প্লেয়ার) সে যাত্রীকে এক একটা মুভ দেখিয়ে কীভাবে সেগুলো প্রতিহত করতে হবে বুঝিয়েছে। ওরা গোল হয়ে ঘিরে বসে গভীর মনোযোগে শুনেছে। যাত্রীর অ্যাটাক প্রধানত কাকে ঘিরে, কোথা থেকে বল আসে, কী কী ফন্দি এঁটে ওরা স্যুটিং স্পেস তৈরি করে, পাহারা দেওয়া ডিফেন্ডারকে সরবার জন্য কীভাবে ওরা বল—ছাড়া দৌড়োদৌড়ি করে, ওভারল্যাপ করে ওদের ব্যাক কী ভাবে ওঠে, কমল ওদের দেখিয়েছে ঢিলগুলি নাড়াচাড়া করে। তারপর বুঝিয়েছে কার কী কর্তব্য। যাত্রীর প্রতিটি প্লেয়ারের গুণ এবং ত্রুটি এবং শোভাবাজারের কোন প্লেয়ারকে কী কাজ করতে হবে বার বার বলেছে। খেলার দিন সকালেও সে সকলকে ডেকে এনে শেষবারের মতো বলে, ”চারজন ব্যাকের পিছনে থাকব আমি। যখনই দরকার তখনই প্রত্যেক ডিফেন্ডারকে কভার দেব। ডিফেন্ডাররা নিজের নিজের লোককে ধরে রাখবে। মুহূর্ত দেরি না করে ট্যাকল করবে। বল ওরা কন্ট্রোলে আনার আগেই চ্যালেঞ্জ করবে। বিশেষ করে প্রসূনকে। যেখানে ও যাবে সলিল ছায়ার মতো সঙ্গে থাকবে। অনুপমকে দেখবে স্বপন। চারজন ব্যাকের সামনে থাকবে শম্ভু। প্রত্যেকটা পাস মাঝপথে ধরার চেষ্টা করবে, যেন যাত্রীর কোনও ফরোয়ার্ডের কাছে বল পৌঁছতে না পারে। অ্যাটাক কোথায় থেকে শুরু হচ্ছে দেখা মাত্র গিয়ে চ্যালেঞ্জ করবে। শম্ভুর সামনে তিনজন হাফ ব্যাক থাকবে। যাত্রীর অ্যাটাক শুরু হবার মুখেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আবার দরকার হলে নেমে এসে হেলপ করবে, আবার কাউন্টার—অ্যাটাকে বল নিয়ে এগিয়ে যাবে। আর যাত্রীর পেনাল্টি বক্সের কাছে থাকবে গোপাল। মোট কথা, আমাদের ছকটা হবে ১—৪—১—৩—১।”
”কমলদা, আমি কিন্তু ওদের দু—একটাকে বার করবই।” শম্ভু গোঁয়ারের মতো বলেছিল।
কমল কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ”ওদের একজনকে বার করার সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও বেরিয়ে যেতে হবে। তাতে ক্ষতি হবে শোভাবাজারেরই। শম্ভু, আজ সব থেকে দায়িত্বের কাজ তোমার উপর। তুমি কি দায়িত্বের ভয়ে পালিয়ে যেতে চাও?”
”কে বলল?” শম্ভু লাফিয়ে উঠল। চোখ দিয়ে রাগ ঠিকরে পড়ল। দেয়ালে ঘুষি মেরে সে বলল, ”আমি পালাব, আমি পালিয়ে যেতে চাই? আমার বাপ দেশ ভাগ হতে পালিয়ে এসেছিল। শেয়ালদার প্ল্যাটফর্মে আমি জন্মেছি কমলদা, আমার মা মরেছে উপোস দিয়ে, বড় ভাই মরেছে খাদ্য আন্দোলনে গুলি খেয়ে। আমি চুরিচামারি অনেক করেছি। আজ ছিঁড়ে খাব সবাইকে।”
কমল পর পর সকলের মুখের দিকে তাকায়, তারপর ফিসফিসে গলায় বলে, ”আজ শোভাবাজার লড়বে।”
ওরা চুপ করে শুধু কমলের দিকে তাকিয়ে থেকেছিল।
.
।।সতেরো।।
তারপর শোভাবাজার লড়াই শুরু করল।
কিক অফের সঙ্গে সঙ্গে অনুপম ছুটতে শুরু করল আর প্রসূন ডান টাচ লাইনে লম্বা শটে বল পাঠাল, ছোটবার মাথায় অনুপম বলে পা দেওয়া মাত্র স্বপন বুলডোজারের মতো এগিয়ে এসে ধাক্কা মারল। ফাউল। গ্যালারিতে বিশ্রী কথাবার্তা আর চিৎকার শুরু হয়ে গেল। যাত্রীর রাইট ব্যাক ফ্রি কিক করে পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে বল ফেলা মাত্র প্রাণবন্ধু হেড দিয়ে ক্লিয়ার করার জন্য উঠল, আর প্রায় পনেরো গজ ছুটে এসে ভরত তার মাথার উপর থেকে বলটা তুলে নিয়ে একগাল হাসল।
”ভরত, হচ্ছে কী, গোলে দাঁড়া।” কমল ধমক দিল।
কিক করে বলটা মাঝমাঠে পাঠিয়ে ভরত বলল, ”কমলদা, পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে কাউকে আজ মাথায় বল লাগাতে দেব না।”