”ফুটবল যারা খেলে তাদের তুমি ঘৃণা করো। যেমন আমায় করো।” কমল অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে, কিন্তু প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট ভাবে ধীরে ধীরে উচ্চচারণ করল, ”তোমার মা’র মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী ভেবে তুমি কখনও আমায় সহজভাবে নিতে পারোনি, বাপ—ছেলের স্বাভাবিক সম্পর্ক আমাদের যেন হয়নি। হ্যাঁ, স্বীকার করি, তাকে অবহেলা করে আমি ফুটবলকেই বড় করে দেখেছি। আমি শুধু জানতে চাই, আমার প্রতি ঘৃণাটা তোমার আছে কি এখনও?”
অমিতাভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ”আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন?”
”কৌতূহলে। তোমার কি কখনও কৌতূহল হয় না, খেলার জন্য তোমার মাকে অগ্রাহ্য করেছে যে লোক, তার খেলা একবারও দেখার?”
”হয়, কিন্তু ওই কারণে নয়। ফুটবলকে এত ভালবেসে শেষে অপমান ও তাচ্ছিল্য নিয়ে খেলা থেকে সরে যাচ্ছে যে লোকটি, তার খেলা একবার দেখতে ইচ্ছে করে।”
কমল তীব্র চোখে তাকাল ছেলের দিকে। অমিতাভ অচঞ্চল।
”শুধু এই জন্য ইচ্ছে করে?”
”না। খেলাকে ভালবাসলে মানুষ কী পরিমাণ পাগল হয়, সেটা দেখতে দেখতেই আমার কৌতূহল জেগেছে।”
”কাকে দেখে, সলিলকে?”
অমিতাভ চমকে উঠে কমলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বিস্ময় তার সারা মুখে।
”তুমি ওকে আশ্রয় দিয়েছ কেন?” কমল কঠিন স্বরে প্রশ্ন করল।
”ও আমাকে অবাক করেছে। সেদিন অমানুষিক মার খাবার পর বলেছিল, কমলদার মতো আমার মাথায় দাগ তৈরি হবে না, আমার মাথা ফাটেনি। এই বলে ও কেঁদেছিল। ও আশ্রয় চেয়েছিল, আমি আশ্রয় দিয়েছি। এই ঘরে। ভোরে বেরিয়ে যায়, দুপুরে আসে, বিকেলে বেরিয়ে রাত্রে আসে। ও নিজের বাপ—মা ভাই—বোনদের ত্যাগ করেছে। ওর মধ্যে আমি অনেক কিছু না বোঝা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি।”
”কী বুঝেছ, কী বুঝেছ?” কমল উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠল। ”আমার কোনও দোষ ছিল না। খেলা শুধু শারীরিকই নয়, একটা মানসিক ব্যাপারও—সেটা বুঝেছ কি?”
”আপনার খেলা দেখার পর সেটা বুঝব।”
”তুমি আমার খেলা দেখবে!” কমল হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে হাতটা নামিয়ে নিল। অমিতাভ মাথাটা কাত করল।
কমল পরদিন অফিস থেকে শোভাবাজার টেন্টে ফোন করল, ”আমি খেলব, যাত্রীর সঙ্গে খেলাটায়।”
.
।।ষোলো।।
কাঁসর, শাঁখ, পটকা নিয়ে যাত্রীর সমর্থকরা ইস্টবেঙ্গল মাঠের সবুজ গ্যালারি ছেয়ে রয়েছে। দশ গজ পর পর হাতে উড়ছে যাত্রীর পতাকা। যুগের যাত্রী আজ লিগ চ্যামপিয়ন হবে। যাত্রীর ইতিহাসে প্রথম। আর দু’টি পয়েন্ট তাদের দরকার। যাত্রীর সমান খেলে ইস্টবেঙ্গল এক পয়েন্টে পিছিয়ে, মোহনবাগান তিন পয়েন্ট, মহমেডান ছয় পয়েন্ট। প্রত্যেকেরই একটি করে খেলা বাকি। যাত্রীকে আর ধরা যাবে না। যদি আজ যাত্রী ড্র করে এক পয়েন্ট খোয়ায়, তা হলে ইস্টবেঙ্গল সমান সমান হবার সুযোগ পাবে, কেননা তাদের শেষ ম্যাচ জর্জ টেলিগ্রাফের সঙ্গে। প্রথম খেলায় টেলিগ্রাফকে চার গোলে হারিয়েছে ইস্টবেঙ্গল।
গ্যালারিতে একজন দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল,”যাত্রী আজ যদি হেরে যায়! খেলার কথা তো কিছুই বলা যায় না।”
অবশ্য লোকটি কয়েক মুহূর্ত পরেই বুদ্ধিমান হয়ে গেল এবং সবাইকে শুনিয়ে বলল, ”পি সি সরকার কিংবা পেলে ছাড়া যাত্রীকে আজ হারাবার ক্ষমতা কার আছে! আগের ম্যাচে কীভাবে শোভাবাজার পাঁচ গোল খেয়েছিল মনে পড়ে?”
”শোভাবাজারের সেই টিমই খেলবে।” খুব বোদ্ধার মতো আর একজন বলল, ”সিজন যত শেষ হয়ে আসে, বর্ষা নামে, ছোট টিম ততই টায়ার্ড হয়, খারাপ খেলে। আমার তো মনে হয়, রেকর্ড গোল দিয়ে যাত্রীর লিগ চ্যামপিয়ন হওয়ার আজই সুযোগ।”
”দাদা, আগের ম্যাচে তো কমল গুহ খেলেছিল, আজও খেলবে কি?”
”কে জানে? অনেকদিন তো কাগজে নামটাম চোখে পড়েনি? আর খেললেই বা কী আসে যায়?”
”জানেন তো যাত্রী ছেড়ে যাবার সময় কমল গুহ কী বলেছিল?”
”আরে রাখুন ওসব বলাবলি। অনুপম আর প্রসূন আজ ওর পিণ্ডি চটকে ছাড়বে। দম্ভ নিয়ে মশাই ক’জন তা রাখতে পেরেছে? রাবণ পারেনি, দুর্যোধন পারেনি, হিটলার পারেনি, আর কমল গুহ পারবে?”
আজ শোভাবাজারের সমর্থক শুধু ইস্টবেঙ্গল মেম্বার—গ্যালারিতে। তাদের মনে একটা ক্ষীণ আশা—যদি যাত্রী হারে। হারলে, ইস্টবেঙ্গলের চ্যামপিয়ন হওয়া ওই পেলে বা পি সি সরকারও বন্ধ করতে পারবে না।
”অসম্ভব, হতি পারে না। যাত্রীর হার হতি পারে না। শোভাবাজারের আছেডা কে? লিগটা লইয়াই গেল শ্যাস পর্যন্ত।” কপালে করাঘাত হল।
”চ্যাঁচাইয়া যদি জেতান যায় তো আজ কলজে ফাটাইয়া দিমু। কী কস?”
”তাই দে।”
”নিচ্চচয়, আজ যেমন কইরা হোক জেতাইতে হইবই। ক্যান, স্পোর্টিং ইউনিয়নের দিন জেতাই নাই ইস্টবেঙ্গলেরে।”
”আরে মশাই, চেঁচিয়ে জেতাবেন শ’বাজার সে টিম নয়। পহাকড়ি দিয়ে দু—চারটে প্লেয়ারকে যাত্রী ঠিক ম্যানেজ করে রেখেছে। ষোল বচ্চচর তো খেলা দেখচি।”
”ছারপোকা! আমাগো গ্যালারিতে?”
”ছাইড়া দে। অগো আর আমাগো আজ কমন ইন্টারেস্ট। ইংরাজি বোঝোস তো?”
”চার বছছর আই এছছি পড়ছি। ইন্টারেস্ট মানে সুদ তা আর জানি না?”
পাশেই এরিয়ানের গ্যালারির অংশে রয়েছে যুগের যাত্রীর মেম্বাররা। সেখানে হইহই পড়ে গেছে বিপুল কলেবর ‘ফিল্ডমার্শাল’ কে দেখে। বিরাট গোঁফওলা লোকটি, চারটি সিগারেট মুঠো করে রাখা পাঁচ আঙুলের ফাঁকে। এক একটি টান দিচ্ছে আর মুখ থেকে পাটকলের চিমনির মতো ধোঁয়া বার করছে। যাত্রী ম্যাচ জেতার পর ফিল্ডমার্শাল এইভাবে সিগারেট খায়। আজ খেলা শুরুর আগেই খাচ্ছে।