কমল বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হতেই ভরত মাথা চুলকে বলল, ”সেদিনের পর থেকে আর আপনি মাঠে আসেন না।”
”হ্যাঁ, আর ভাল লাগে না। মাঠ থেকে এবার চলে যাওয়াই উচিত। আমার কোনও ফোন এসেছিল কি?”
”জানি না তো।”
.
।।পনেরো।।
বাড়ি ফিরেই কমল শুনল যে, কালোর মা গজগজ করে চলেছে, ”বাইরের লোকের প্যান্ট আমি কেন কাচব? বাইরের লোকের খাওয়া এঁটো বাসন মাজতে হবে, এমন কথা তো বাপু ছিল না। মাইনে না বাড়ালে আমি আর বাড়তি কাজ করতে পারব না।” ইত্যাদি ইত্যাদি?
বাইরের লোকটা আবার কে?” কমল কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করে।
”কেন, দাদাবাবুর যে বন্ধুটি থাকে!”
”থাকে! দাদাবাবুর বন্ধু?”
”কেন, আপনি জানেন না?” কালোর মা বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলার উপক্রম করতে কমল আর কথা বাড়াল না।
রাত্রে কমলের মনে হল, অমিতাভর ঘরে চাপা স্বরে কারা কথা বলছে। সকালে অমিতাভর ঘরের সামনে দিয়ে যাতায়াত করবার সময় খুঁটিয়ে ঘরের মধ্যে লক্ষ করে সে কিছুই বুঝতে পারল না। ভাবল, অমিতাভকে জিজ্ঞাসা করবে।
অফিসে বেরোবার সময় অমিতাভ তার কাছে কুড়িটা টাকা চাইল। এক সপ্তাহে চল্লিশ টাকা দিয়েছে, তাই কমল অস্বস্তিভরে বলল, ”হঠাৎ এত ঘন ঘন টাকার দরকার হচ্ছে যে? আমি যা মাইনে পাই তাতে এভাবে চললে কুলিয়ে ওঠা তো সম্ভব হবে না।”
”এক বন্ধুর অসুখ, তাকে ওষুধ কিনে দেবার জন্য—” অমিতাভ ঢোঁক গিলে বলল।
”কালোর মা বলছিল তোমার এক বন্ধু নাকি এখানে খায়?”
”তিন—চার দিন খেয়েছে। আর খাবে না।”
টাকা দেবার সময় কমল বলল, ”খাওয়ার জন্য আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।”
এরপর কমল লক্ষ করল, অমিতাভ যেন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। গম্ভীর ভারিক্কি ভাবটা আর নেই, চলাফেরায় চঞ্চলতা দেখা যাচ্ছে, চেঁচিয়ে হঠাৎ গানও গেয়ে ওঠে, এমনকী একদিন সকালে উঠে চা তৈরি করে সে কমলকে ডেকে তুলেছে। কমল লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে, ”খেলা ছেড়ে দিয়ে দেখছি অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সকালের একসারসাইজটা আমার শুরু করতে হবে কাল থেকে।”
”আপনি খেলা ছেড়ে দিয়েছেন?” অবাক হয়ে অমিতাভ জিজ্ঞাসা করে।
”হ্যাঁ।”
”কেন?”
কমল জবাব না দিয়ে বাজার রওনা হয়। সেইদিন শোভাবাজার টেন্টে গিয়ে সে শোনে, মহামেডানের সঙ্গে খেলায় বলাই ও অ্যামব্রোজ মারপিট করায় রেফারি দু’জনকেই মাঠ থেকে বার করে দিয়েছে, আর শ্রীধরের হাঁটুর পুরনো চোটটায় আবার লেগেছে, যার ফলে তাঁর দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। টেন্টে সকলেরই মুখ শুকনো, দুশ্চিন্তায় কপালে কুঞ্চন। খেলার মতো এগারো জন প্লেয়ার এখন শোভাবাজারের নেই। সহসম্পাদক অবনী মণ্ডল ওকে দেখে ছুটে এসে বলে, ”কমলবাবু, আপনার কাছেই যাব ভাবছিলুম! আপনাকে বাকি ম্যাচ তিনটে খেলতে হবে।”
”না।” কমল গম্ভীর স্বরে বলে, ”আমি আর খেলব না।” তারপর সে টেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে হতভম্ব অবনী মণ্ডলকে ফেলে রেখে।
অস্বস্তিপূর্ণ মন নিয়ে কমল বাড়ি ফিরল। শোভাবাজার এখন সত্যিই দুরবস্থায়। অথচ সে বলে এল খেলবে না। এই ক্লাব থেকেই সে গড়ের মাঠে খেলা শুরু করেছিল। ব্যাপারটা নেমকহারামির মতো লাগছে। ইচ্ছে করলে তিনটে ম্যাচ এখন সে অনায়াসে খেলে দিতে পারে। শেষ ম্যাচটা যাত্রীর সঙ্গে। গুলোদার বিদ্রুপভরা কথাগুলো কমলের কানে বেজে উঠল। তপেন রায়ের হাতে একশো টাকার নোটটা দেবার আগে সে বলেছিল, আর খেলবে না। তখন দাউদাউ আগুন জ্বলছিল মাথার মধ্যে। আর এখন শুধু ছাই হয়ে পড়ে আছে তার প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছাটা।
অভিতাভর ঘর অন্ধকার। কমল নিজের ঘরে ঢুকে জামাপ্যান্ট বদলে ইজিচেয়ারে গা ঢেলে দিল আলো নিভিয়ে। কুড়ি বছরের খেলার জীবনের অজস্র কথা আর দৃশ্য মনের মধ্যে ভিড় করে ঠেলাঠেলি করছে। তার মধ্যে বার বার দেখতে পাচ্ছে পল্টুদাকে, শুনতে পাচ্ছে তাঁর গলার স্বর—”প্র্যাকটিসটা আরও ভাল কর। হতাশা আসবে, তাকে জয় করতেও হবে… তুই খেলা ছেড়ে দিবি বলছিস, তার মানে তুই বড় খেলোয়াড় হতে পারিসনি।”
না,পারিনি। কমল বার বার নিজেকে শোনাতে থাকে, পারিনি, পারিনি, আমি হতে পারিনি। আমার মধ্যে প্রশান্তি আসেনি। অনেক কিছুই অপূর্ণ রয়ে গেছে।
অমিতাভর ঘরের দরজা খোলার এবং আলো জ্বালানোর শব্দ হল। কমলের মনে পড়ল আজ সকালে সে স্কিপিং দড়িটা খুঁজে পায়নি। অমিতাভ কি কোনও কাজে নিয়ে গেছে তার ঘরে! জিজ্ঞাসা করার জন্য সে উঠল। আলো জ্বালল। চটি করে ‘অমিত’ বলে ডেকে ঘর থেকে বেরোবার সময় তার মনে হল, পাশের ঘরে দ্রুত একটা ঘষড়ানির শব্দ হল। দ্রুত অমিতাভর ঘরের দরজায় পৌঁছে সে দেখল, খাটের নীচে কেউ ঢুকে যাচ্ছে, পলকের জন্য দুটি পা শুধু দেখতে পেল।
চোর! কমল থমকে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও চেঁচাল না। পা দুটো তার চেনা মনে হল। প্যান্টের যতটুকু দেখতে পেয়েছে, সেটাও খুব পরিচিত। সলিল।
দু’হাতে পাঁউরুটি নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে অমিতাভ থমকে তারপর আড়ষ্ট হয়ে গেল কমলকে খাটে বসে একটা বইয়ের পাতা ওলটাতে দেখে।
”পাঁউরুটি! কেন, ভাত রান্না হয়নি?”
”আজ শরীরটা ভাল নয়, তাই—”
”এতগুলো? এ তো প্রায় দু’জনের মতো দেখছি!”
”কালকের জন্যও এনে রাখলুম।”
কমল গম্ভীর মুখে আবার কয়েকটা পাতা উলটিয়ে গেল। অমিতাভ সন্তর্পণে ঘরের চারধারে চোখ বুলিয়ে নিল।