”একটু দরকার ছিল।”
”দেখেছ তো কী অবস্থা, এখান থেকে নড়ার উপায় নেই, যা বলার বরং এখানেই বলো।”
কমল নোটটা পকেট থেকে বার করে এগিয়ে ধরে বলল, ”টাকাটা দিতে এসেছি।”
তপেন রায় কী ভেবে নিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”ও টাকা তুমিই রাখো। এত বছর যাত্রীতে খেলে গেলে—ট্রফিফ্রফি তো কিছুই ক্লাবকে দিতে পারোনি, টাকা ফেরত দিয়ে ক্লাবের কী আর এমন উপকার করবে? এবছর যাত্রী লিগ পাচ্ছেই, শুধু বড় টিম দুটোর সঙ্গেই আসল যা খেলা বাকি; তারপর শুধু বাজিই পুড়বে দশ হাজার টাকা। একশো টাকার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমার নেই।”
শুনতে শুনতে কমলের পা দুটো কেঁপে উঠল। মাথার মধ্যে লক্ষ গোলের চিৎকার। তবু ঠাণ্ডা গলায় বলল, ”বাজি পোড়ানো দেখতে আমি আসব। কিন্তু টাকা আপনাকে ফেরত নিতে হবে। যাত্রীর কাছে আমি ঋণী থাকব না, থাকতে চাই না।”
ওদের ঘিরে বহু লোকের ভিড় জমে গেছে। গুলোদা এই সময় টেন্টে ঢুকল। ভিড় দেখেই কৌতূহলভরে এগিয়ে এল।
”ব্যাপার কী? আরে কমল যে!”
”এক সময় দরকারে টাকা নিয়েছিলুম। ফেরত দিতে এসেছি, কিন্তু তপেনদা নিচ্ছেন না।”
”সেই টাকাটা গুলোদা, আপনিই তো বলেছিলেন দরকার নেই ফেরত নেবার।” তপেন রায় মনে করিয়ে দিল ব্যস্ত ভঙ্গিতে।
”অ। দিতে চায় যখন নিয়ে নাও তবে,” গুলোদা অতি মিহি স্বরে বলল, ”যাত্রীর শেষ খেলা শোভাবাজারের সঙ্গে, যদি কমল কথা দেয় সেদিন খেলবে না, তা হলেই ফেরত নেব।”
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ”খেললেই বা কমল গুহ, যাত্রী এবার দশ গোল ভরে দেবে শোভাবাজারকে।”
স্মিত মুখে গুলোদা বলল, ”সেইজন্যই তো বলছি, কমলের মতো এতবড় প্লেয়ারের টিম দশ গোল খাচ্ছে, এ দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারব না। এটা যাত্রীর পক্ষেও বেদনাদায়ক হবে। হাজার হোক এক সময় কমল তো যাত্রীর—ই ছিল।”
”ঠিক ঠিক, গুলোদা ঠিক বলেছেন।” ভিড়ের মধ্যে একজন মাথা নেড়ে বলল, ”কমলদা, আপনি কিন্তু সেদিন খেলতে পারবেন না। আপনার ইজ্জতের সঙ্গে যাত্রীর ইজ্জতও জড়িয়ে আছে।”
পাংশু কালো মুখ নিয়ে কমল হাসল। এরা আজ অপমান করার জন্য পন্থা নিয়েছে করুণা দেখাবার। ওর ইচ্ছে করল নোটটা টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠতে—আমি এখনও শেষ হয়ে যাইনি, যাইনি। ঠিক তখনই কমলের বুকের মধ্যে এক বৃদ্ধের কণ্ঠ ফিসফিস করে উঠল—ব্যালান্স, কমল, ব্যালান্স কখনও হারাসনি।
ম্লান চোখে কমল সকলের মুখের উপর দিয়ে চাহনি বুলিয়ে ধীর স্বরে বলল, ”টাকাটা ফেরত নিন। আমার আর খেলার ইচ্ছে নেই।”
নোটটা তপেন রায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে কমল বেরিয়ে এল যাত্রীর টেন্ট থেকে। মাথার মধ্যেটা অসাড় হয়ে গেছে। হাঁটু দুটো মনে হচ্ছে মাখনে তৈরি, এখনি গলে গিয়ে তাকে ফেলে দেবে। বুকের মধ্যে দপদপ করে জ্বলে উঠতে চাইছে শোধ নেবার একটা প্রচণ্ড ইচ্ছা। যে বিমর্ষতা, হতাশা তাকে এই ক’দিন দমিয়ে রেখেছে, সেটা কেটে গিয়ে এখন সে অপমানের জ্বালায় ছটফট করে উঠল। উদ্দেশ্যহীনের মতো ময়দানের মধ্য দিয়ে এলোপাথাড়ি হাঁটতে হাঁটতে কমল কখন যে শোভাবাজার টেন্টে পৌঁছে গেছে খেয়াল করেনি। ডাক শুনে তাকিয়ে দেখল, ভরত আর সলিল ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে। ভরত এগিয়ে এল, সলিল এল না।
”আপনার কি অসুখ করেছে কমলদা? কেমন যেন শুকনো দেখাচ্ছে। অনেক দিন আসেন না, ভেবেছিলুম আপনার বাড়িতে যাব।”
প্রশ্নটা এড়িয়ে কমল বলল, ”ক্লাবের খবর কী, বল।”
”খবর আর কী, যা হয়ে থাকে প্রতি বছর তাই হচ্ছে। তিনটে ড্র করে তিন পয়েন্ট ম্যানেজ হয়েছে, তবু এখনও ভয় কাটেনি।” ভরত বিপন্ন হয়ে বলল, ”ভাল লাগে না কমলদা। এইভাবে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার কোনও মানে হয় না।”
”সলিল কি খেলছে?”
”কেন, আপনি জানেন না! ও তো লাস্ট চারটে ম্যাচে খেলেছে, বেশ ভাল খেলছে। ইস্টবেঙ্গলের দিন হাবিবকে নড়াচড়া করতে দেয়নি। সব কাগজে ওর কথা লিখেছে।”
”তাই নাকি, আমি কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আর কী খবর আছে?”
”আর যা আছে সেটা খুব মজার। সত্য আর শম্ভু তো গোলাম আলিতে স্যুটের মাপ দিয়ে এসেছিল। সাত দিন পর ট্রায়াল দিতে গিয়ে শোনে, গুলোদা টেলিফোন করে আগেই জানিয়ে রেখেছিল, তার অর্ডার না পাওয়া পর্যন্ত কাঁচি ধরবে না, শুধু মাপটা নিয়ে রেখে দেবে। গুলোদা আর ফোন করেনি। শুনে সত্য আর শম্ভু তো ফুঁসছে, এভাবে বোকা বনে যাবে ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। কথাটা কাউকে বলতেও পারছে না, কিল খেয়ে কিল চুরি করা ছাড়া ওদের আর উপায় নেই। এখন বলছে, রিটার্ন ম্যাচটায় যাত্রীকে দেখে নেব।”
কমল ফিকে হাসল মাত্র কথাগুলো শুনে। বলল, ”সরোজ কোথায়, প্র্যাকটিস কেমন চলছে?”
”কোথায় প্র্যাকটিস! সরোজদা তো প্রায় দশ দিন হল টেন্টই মাড়ায় না। শুনছি জামশেদপুর না দুর্গাপুরে চাকরি পেয়েছে। সলিল, স্বপন, রুদ্র, এরাই যা বল নিয়ে সকালে নাড়াচাড়া করে। সকালে এখন এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট ছাড়া আর সব বন্ধ করে দিয়েছে কেষ্টদা।”
”সলিল চাকরিটা করছে কি এখনও?”
”একদিন ওর বাবা এসেছিল খুঁজতে। সলিল কাজ ছেড়ে দিয়েছে, বাড়িতেও থাকে না। কোথায় থাকে কেউ জানে না। ওকে জিজ্ঞেস করেছি, ঠিকানা দেয়নি।”
”সলিলকে বলিস আমার সঙ্গে দেখা করতে।”