কিন্তু সেকথা এখন বললে লোকে বলবে সাফাই গাইছে। উপায়ও নেই, মুখ দেখাবার কোনও উপায় আর রইল না। বিদ্রূপ আর ইতর মন্তব্য শুনতে হবে বহুদিন। কমল বিছানায় মুখটা চেপে ধরে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল।
হঠাৎ ঘরের আলোটা কে জ্বালল। কমল ছিটকে উঠে বসল।
”কমলদা, আমি এসেছি।” ঘরের মধ্যে সলিল দাঁড়িয়ে। মুখে লাজুক বিব্রত হাসি।
”কেন?”
”শুনলুম আজ পাঁচ গোলে শোভাবাজার হেরেছে।”
কথা না বলে কমল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
”আমি খেলব কমলদা। আমি আর বাড়িতে ফিরব না। কাজ আমি করতে চাই না, আমি খেলতে চাই। আমাকে শুধু দু’মুঠো খেতে দেবেন আর একটু ঘুমোবার জায়গা।”
উঠে দাঁড়াল কমল।
”আমি বাড়ির জন্য আর ভাবব না। ওদের বাঁচানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি—”
এরপরই সলিল পেটটা চেপে ধরে ছিটকে দেয়ালে আছড়ে পড়ল কমলের লাথি খেয়ে।
”কী জন্য এসেছিস এখানে! রাসকেল, করুণা দেখাতে এসেছিস? পাঁচ গোল খেয়েছি বলে সাহায্য করতে এসেছিস? ফুটবল খেলে আমায় উদ্ধার করতে এসেছিস?” বলতে বলতে কমল আবার লাথি কষাল। সলিল কাত হয়ে মেঝেয় পড়ে গেল। তার পিঠে কোমরে মাথায় কমল পাগলের মতো এলোপাথাড়ি লাথি মারতে শুরু করল। চুল ধরে টেনে তুলে মুখে ঘুষি মারল।
”আমায় মারবেন না কমলদা, আমি চলে যাচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি।” সলিল উঠে বসতেই কমল ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।
”কেন এসেছিস, বল কেন এসেছিস?”
সলিল হাঁ করে মুখটা তুলে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে, নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে আর চোখ বেয়ে জল। ও বলার আগেই দরজার কাছে অমিতাভ বলে উঠল, ”ছাড়ুন, ওকে ছাড়ুন।”
দ্রুত ঘরে ঢুকে সে সলিলের চুল—ধরা কমলের হাতে ধাক্কা দিল।
”তোমার কী দরকার এখানে?”
”আপনি এভাবে মারছেন কেন ওকে?”
”আমি যা করছি তাতে তোমার নাক গলাতে হবে না।”
”একজনকে এভাবে মারবেন আর তাই দেখে বাধা দেব না? দেখুন তো কী অবস্থা হয়েছে ওর! জানোয়ারকেও এভাবে মারে না।”
”না না, কমলদা আমায় মারেননি।” সলিল দু’হাত তুলে অমিতাভর কাছে আবদেন জানাল ঘড়ঘড়ে স্বরে। ”কমলদা আমায় কখনও মারেন না, শুধু আমায় শাস্তি দেন।”
”চুপ করো তুমি।” অমিতাভ ধমক দিল সলিলকে। তারপর ঝুঁকে তার শীর্ণ হাতটা বাড়িয়ে সলিলের কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল। ”এসো আমার ঘরে, মুখ ধুইয়ে মলম লাগাতে হবে।”
অমিতাভ বেরিয়ে যাবার সময় থমকে একবার কমলের দিকে তাকাল। অদ্ভুত একটা ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে কমলের মুখে ফুটে উঠেছে দীনতার ছাপ। বয়সটা যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। কমল কুঁজো হয়ে ধীর গতিতে এসে খাটের উপর বসল। শূন্য দৃষ্টিতে সলিলের দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্কের মতো চুলে আঙুল চালাতে লাগল।
সলিল ওঠবার চেষ্টা করে যন্ত্রণায় কাতরে উঠে পেট চেপে বসে পড়ল। আবার চেষ্টা করল ওঠবার। আবার বসে পড়ল। অসহায়ভাবে কমলের দিকে তাকাল। একদৃষ্টে কমল তার দিকে তাকিয়ে, চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।
”আপনার মাথায় দাগটা এখান থেকেও আমি দেখতে পাচ্ছি কমলদা।”
কমল নিরুত্তর রইল। সলিল হাসবার চেষ্টা করল, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কমল চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ পর অমিতাভ ঘরে ঢুকে মৃদু স্বরে বলল, ”আপনি শুয়ে পড়ুন।”
কমল মুখ তুলে কিছুক্ষণ ধরে অমিতাভর মুখের উপর চোখ রাখল। ক্রমশ সংবিৎ ফিরে এল তার চাহনিতে। মুখ দুমড়ে গেল বেদনায়। ফিসফিস করে সে বলল, ”আমি শেষ হয়ে গেলাম!”
অমিতাভ আলো নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
।।চৌদ্দ।।
পরদিন থেকে কমল যেন বদলে গেল। চোহারায় এবং মনেও। অফিসে সারাক্ষণ নিজের চেয়ারে থাকে। কথা বলে না প্রয়োজন না হলে। ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে আসে। গড়ের মাঠের পথ আর মাড়ায় না। অফিসে অরুণা ফোন করেছিল। কমল কথা বলেনি। বিপুল ঘোষকে সে বলতে বলে, ‘অফিসে আসেনি, জানিয়ে দিন।’
কমল যতটা ভেবেছিল তেমন কোনও বিদ্রূপ অফিসে বা অন্য কোথাও তাকে শুনতে হয়নি। সবাই যেন ধরেই নিয়েছে এমনটিই হবে। ওর মনে হয়, এই রকম ঔদাসীন্যের থেকে বরং বিদ্রূপই ভাল ছিল। মাসের মাইনে পেয়েই সে রথীনের ঘরে গিয়ে একশো টাকার নোট টেবিলে রেখে বলে, ”ধার নিয়েছিলাম, সেই টাকাটা।”
”ধার! আমি তো দিইনি। যে দিয়েছে তাকে দিয়ে এসো।” রথীন কমলের দিকে আর না তাকিয়ে কাজে মন দেয়।
কমল দ্বিধায় পড়ে। অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভেবে সে স্থির করে, তপেন রায়ের হাতেই টাকাটা দিয়ে আসবে। ছুটির পর সে যাত্রীর টেন্টের দিকে রওনা হয়। যখন পৌছল, যাত্রীর প্লেয়াররাও ঠিক তখনই এরিয়ান মাঠ থেকে ফিরল বি এন আর—কে ২—০ গোলে হারিয়ে। প্রায় শ’খানেক লোক হইচই করছে টেন্টের মধ্যে ও বাইরে। কমল একধারে দাঁড়িয়ে খুঁজতে লাগল তপেন রায়কে।
”আরে কমলবাবু, ইখানে দাঁড়িয়ে!” ক্লাবের বুড়ো মালী দয়ানিধি কমলকে দেখে নমস্কার করে এগিয়ে এল।
”তপেনবাবুকে খুঁজছি, কোথায় বলতে পারো?”
”ভিতরে আছে বোধ হয়, যান না।”
ইতস্তত করে কমল ভিতরে গেল।
তপেন রায় কয়েকটি ছেলের পথ আটকে প্লেয়ারদের ড্রেসিংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, ”না না, এখন নয়। ওরা এখন টায়ার্ড। এখন কোনও কথাবার্তা নয়।”
কমল এগিয়ে গেল। তাকে দেখে তপেন রায় অবাক হয়েও স্বাভাবিক স্বরে বলল, ”কী খবর কমল?”