আমি শক্ত হয়ে গেলাম, হর্ষদার গলার স্বর অত্যন্ত ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ়। আমি চুপ করে রইলাম মরা গোলাপ ডালটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। হর্ষদা তা লক্ষ করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ”ডালটা মরে গেছে, কিন্তু গাছটা দ্যাখ কেমন জীবন্ত। অন্য ডালে কতগুলো কুঁড়িও ধরেছে। এরকম হয়, সর্বক্ষেত্রেই হয়। মানুষ বেড়ে ওঠে আর ফেলে যায় তার মরা ডালপালা। নতুন ডালে ফুল ফোটায়। এজন্য পরিচর্যা চাই। সার, জল, রোদের তাপ তাকে দিতে হয়। শিকড় থেকে পাতার মধ্যে দিয়ে সে প্রাণশক্তি আহরণ করে। যদি শিকড় নষ্ট হয়, পরিচর্যা না পায়, তা হলে বাড়তে পারে না। মানুষের শিকড় তার চরিত্র। তুই যদি অনুগ্রহ নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে বড় হতে চাস তো তোর শিকড় পচে যাবে। এই গাছটা বেড়েছে ফাইট করে। আমি একে হেলপ করেছি মাত্র। মানুষ হেলপ নাও পেতে পারে, তখন নিজেকে নিজে হেলপ করতে হয়। যার চরিত্র পচে গেছে, সে পারে না। হেরে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চ্যালেঞ্জ নানা রকম চেহারা নিয়ে আসে, আর মানুষকে তার মোকাবিলা করতে হয়।”
শুনতে শুনতে টের পেলাম সারা শরীরে কলকল শব্দে রক্ত ছুটছে, আর দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট একটা স্বরের মতন আমার বুকের মধ্যে ঢেউ উঠছে। সেই ঢেউয়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে কে যেন বলছে, ”স্ট্রাইকার! স্ট্রাইকার! তোমার সামনে দুর্ভেদ্য ডিফেনস। ভাঙতে কি পারবে না?”
আমি মাথা নামিয়ে নিজেকে শুনিয়ে বললাম, ”পারব।”
হর্ষদা অবাক হয়ে একবার তাকালেন, তার পর মরা ডালটা ছুড়ে ফেলে বললেন, ”মনে আছে, তোকে হেমিংওয়ের একটা গল্প একবার বলেছিলাম—ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি! তাতে এক জায়গায় আছে, ম্যান ক্যান বি ডিফিটেড, বাট… তুই লেখাপড়া শিখলি না কেন রে প্রসূন? তা হলে ইংরিজিতেই বইটা নিজে পড়তে পারতিস। মুখে বললে অনেক কিছু যে নষ্ট হয়ে যায়।”
”আমার মনে আছে হর্ষদা, মানুষকে হারানো যেতে পারে, কিন্তু ধ্বংস করা যেতে পারে না, তাই না?” এই বলে আমি আর সেখানে থাকিনি।
।।১০।।
রাস্তায় বেরিয়ে এলোমেলো হাঁটতে শুরু করি। একা প্রায় ঘণ্টাখানেক আমি হাঁটি। অনেক চেনা ছেলের সঙ্গে দেখা হল, কিন্তু আমি তাদের দেখতে পেলাম না। তারা চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেল। অনেকে ডাকল, আমি শুনতে পেলাম না। ভূতে পাওয়ার মতন আমি শুধু হাঁটলাম। আর হর্ষদার কথাটা আওড়ালাম মনে মনে, ”এখন তোর সামনে চ্যালেঞ্জ, নিবি কি নিবি না, সেটা তুই ঠিক কর।”
”অ্যাই প্রসূন, দেখতেই পাচ্ছ না যে।” থমকে দাঁড়ালাম। নীলিমা সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে। কোমরে হাত, চোখে বিস্ময়।
”বাব্বাঃ, খবরের কাগজে নাম বেরোয়, তাতেই এই—ছবি বেরোলে কী হবে?”
লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ”যাঃ, ও রকম নাম গণ্ডা গণ্ডা লোকের রোজই বেরোয়। শোভাবাজার ইউনিয়নের প্লেয়ারের আবার নাম! সত্যি বলছি, দেখতে পাইনি তোমায়। কোথায় গেছিলে? বাড়ি যাচ্ছ এখন?”
লজ্জাটা কাটিয়ে ওঠার জন্য এলোপাথাড়ি প্রশ্ন করলাম, প্রেশারে পড়ে গ্যালারিতে বল ওড়ানোর মতন।
নীলিমা এবার সত্যিই অবাক হয়ে বলল, ”সে কী, এই সময়ে টিউশনি থেকে রোজ ফিরি, তা ভুলে গেছ? কী ব্যাপার, বলো তো? হাত তুলে দাঁড়াতে বললাম, দাঁড়ালে না। একমনে চলেছ তো চলেছই। কথা বলছ, যেন এই মাত্র পরিচয় হল। উঃ, হয়েছে কী?”
”একটা ব্যাপারে মুশকিলে পড়ে গেছি, সেটা নিয়েই চিন্তা করছিলুম। হর্ষদার বাড়ি থেকে ফিরছি। চলো একটু হাঁটা যাক।”
আমরা দুজনে মন্থরগতিতে হাঁটতে শুরু করলাম। কেউ কথা বলছি না। নীলিমা গম্ভীর হলে গিন্নিবান্নি দেখায়। মা—মরা সংসার দু বছর ধরে চালাতে চালাতে ও রীতিমতো ভারিক্কি হয়ে গেছে। নানান দিক ভেবেচিন্তে বাবার সামান্য আয় আর নিজের টিউশনির টাকায় ওকে সংসার চালাতে হয়। তার উপর নিজের স্কুলের পড়া আছে।
হর্ষদার কথাগুলো মনে পড়ছে আর যেন গায়ে ছ্যাঁকা লাগছে—’যার চরিত্র পচে গেছে, সে পারে না!’ ‘মানুষের শিকড় তার চরিত্র!’ ‘চ্যালেঞ্জ নানা রকম চেহারা নিয়ে আসে!’ ব্যাপার কী! এইসব ভাল ভাল কথা দিয়ে আমি কী করব? ফুটবল, ক্লাব বদল, বেঙ্গল কী ইন্ডিয়া টিমে খেলার সঙ্গে এগুলির কী সম্পর্ক? আমার স্কিল, স্পিড, ড্রিবলিং, স্ট্যামিনা, বুদ্ধি দিয়ে খেলব—এ সবের সঙ্গে চরিত্রের যোগ কোথায়? ভিতরে ভিতরে ছটফট করে উঠলাম এক অসহ্য অসহায়তায়। ধরতে পারছি না আমার অপোনেন্ট যে কে, কী যে তার স্ট্র্যাটেজি, বুঝতে পারছি না।
হালকা হবার জন্যই কথা শুরু করলাম, ”টিউশনি থেকে আসছ বুঝি?”
”না, এক পাবলিশারের কাছে গেছিলাম। প্রুফ দেখার কাজ শিখছি, বাবাই ঠিক করে দিয়েছেন।”
”অনেক টাকা পাওয়া যায়?”
নীলিমা মাথা হেলিয়ে পিছন থেকে বেণীটা সামনে টেনে আনল। বেণীর গোড়ার আলগা চুলগুলো আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, ”অনেক, এক লক্ষ, দু লক্ষ টাকা।”
”ঠাট্টা করছ!”
”মোটেই না। কষ্ট করে সৎভাবে রোজগার করা একটা টাকা আমার কাছে এক লক্ষ টাকার সমান।”
”আমি এখনও রোজগার করতে পারলাম না। বাড়িতে একটা পয়সাও দিই না।” আমি হাসবার চেষ্টা করলাম। নীলিমাও আমার মতন হাসল।
”ফুটবল খেলে তো হাজার হাজার টাকা বছরে পাওয়া যায় শুনেছি। এটাও তো এক রকমের কাজ। যেমন অফিসে, স্কুলে, কলেজে, কারখানায় লোকে কাজ করে। ফুটবলারকে তো ওদের মতনই শিখতে হয়?” নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।