কথাটা আনোয়ারের গায়ে লাগল। তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”দেখেছি, সব তো এক—ঠেঙে। শুধু স্পিড আর শট ছাড়া আছেটা কী? হাবিবকে ওয়াচ করিস। কীরকম ওঠানামা করে, অন্যকে খেলায়, স্পেস কভার করে, কী দারুণ রোখ নিয়ে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”
নিমাই আর কথা বলল না। বাসে ওঠার আগে আমি ওদের বললাম, ”কিন্তু সামনের বছর অন্য ক্লাব দেখতে হবে। এখানে আর নয়।”
.
।।৯।।
বিপিনদা কীভাবে যেন জানতে পারলেন, সামনের বছর আমরা তিনজনই শোভাবাজার ইউনিয়ন ছাড়ব ঠিক করেছি। তিনি আমাদের তিনজনকেই একদিন আড়ালে ডেকে বললেন, ”তোদের জুনিয়ার বেঙ্গলে খেলাব, সামনের বছরটা থেকে যা।”
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কেউ কথা বললাম না। ভিতরে একটা অস্বস্তি শুরু হল, কেননা আমরা জানি বিপিনদা তা পারেন। আই.এফ.এ—তে শোভাবাজারের সেক্রেটারি পরিমল ভটচাজের একটা দল আছে, যারা সব কটা কমিটি দখল করে আছে। তারাই শলা—পরামর্শ করে লিগে ওঠা—নামা বন্ধ করিয়েছে গভর্নিং বডির মিটিং—এ। এতে তাদের বড় লাভ—ফুটবল লিগে প্লেয়ারদের জন্য যে খরচ করতে হত, সেটা আর করতে হল না। কেউ টাকা চাইলেই তারা এখন বলে দিতে পারে—গেট খোলা আছে, বেরিয়ে যাও। আমরা রাস্তা থেকে এগারোটা ছেলে ধরে এনে খেলাব। সব ম্যাচ হারলেও, একটা পয়েন্ট না পেলেও কিছু আসে—যায় না, ওঠা—নামা তো বন্ধ।
সত্যি বলতে কী, অবস্থাটা এই রকম না হলে আমাদের মতন আনকোরা উটকো তিনজন ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ এত তাড়াতাড়ি পেতাম কি না সন্দেহ। প্রতি বছরই শোভাবাজারের অন্তত দু—তিনজন জুনিয়ার বেঙ্গল টিমে থাকে জুনিয়ার ন্যাশনাল চ্যামপিয়নশিপে। জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমেও দুজন ছিল গত বছর।
”বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথা?” বিপিনদা খুব গম্ভীর হয়ে বললেন।
”না—না, তা কেন, তবে—” নিমাই আমাদের মুখপাত্র হয়ে বলল।
”তবে কী? টাকা চাই, চাকরি চাই?”
”না, তা নয়, বড় ক্লাবে খেলার ইচ্ছে তো সকলেরই থাকে।” নিমাই বলল।
”জুনিয়ার বেঙ্গল, জুনিয়ার ইন্ডিয়া, এর থেকেও বড় ক্লাব আর কী আছে! আগে এসব ছাপ নিয়ে নে, তখন দেখবি, বড় ক্লাব তোদের বাড়িতে গিয়ে সাধাসাধি করবে।”
বলতে ইচ্ছে করল, অমন গণ্ডা গণ্ডা ইন্ডিয়া ছাপ মারা প্লেয়ার ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্লেয়ার তো মাত্র দু—তিনজন হতে পেরেছে। কিন্তু এসব কথা এখন বলে কোনও লাভ নেই, তাতে তিক্ততাই শুধু বাড়বে। তাই বললাম, ”বিপিনদা, আমরা ভাল করে খেলা শিখতে চাই, ভাল প্লেয়ারদের পাশে থেকে খেলতে চাই। দেখছেন না, প্রত্যেকটা ম্যাচে নিমাই—আনোয়ারের অবস্থা, আমার অবস্থা। কেউ সামলাতে পারে না, আটকাতে পারে না, একটা পাস দিতে পারে না ঠিকমতো, দম নেই, স্কিল নেই, বুদ্ধি নেই। এখানে আমি উৎসাহ পাই না। একা একা কি ফুটবল খেলা যায়?”
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। গলা চড়ে গেল। নিমাই আর আনোয়ার আমার কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছিল।
বিপিনদার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। ”তোরা ক্লাব ছাড়লে পরিমলদা চটবে। ওকে চটিয়ে পারবি উঁচুতে উঠতে? প্রত্যেকটা ক্লাব ওকে ভয় করে। ইন্ডিয়া টিমে তোদের খেলা বন্ধ করে দিতে পারে, যতই তোরা ভাল খেলিস না কেন। আর, তারই ক্লাবে তোরা খেলবি না, রিকোয়েস্ট সত্ত্বেও?”
আমরা আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।
আমরা যে দ্বিধায় পড়েছি বিপিনদা বোধ হয় সেটা বুঝতে পারলেন। ”একটা বছর থেকে যা। সামনের বছর সম্ভবত আবার প্রমোশন রেলিগেশন চালু হবে। আমাদের ক্লাবের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস, কয়েকটা মাত্র মেম্বার, আই—এফ—এর ডোনেশনে কি সারা বছর এতগুলো খেলা চলে? এর—ওর কাছে ভিক্ষে করেই চালাতে হয়। তবু কথা দিচ্ছি, সামনের বছর প্রথম কিছু কিছু হাত— খরচা দেবার চেষ্টা করব। থেকে যা তোরা। শোভাবাজারই তোদের প্রথম ফার্স্ট ডিভিশনে খেলিয়েছে, এটা ভুলে যাসনি। তোরা বড় হবি, ফেমাস হবি—এটা কি আমরাও চাই না? তখন কি আমরাও গর্ব করব না?”
বিপিনদাকে অত্যন্ত করুণ দেখাচ্ছে। গলার স্বর গাঢ় আর ভিজে। ভিতরে ভিতরে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ছি। পরিমল ভটচাজকে আমরা চোখে দেখেছি মাত্র, আর ওঁর সম্পর্কে শুনেছি অনেক কথা। নিজের স্বার্থ আর ক্ষমতা রক্ষার জন্য উনি যাবতীয় অপকর্ম করতে পারেন ও করেন। যে কোনও ফুটবলারের কেরিয়ার খতম করা ওঁর পক্ষে অতি সামান্য ব্যাপার। বিপিনদা সে সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন একটা হুমকিও দিলেন।
নিমাই হঠাৎ বলল, ”আচ্ছা, আমরা দু দিন ভেবে আপনাকে জানাব।”
বিপিনদা আমাদের তিনজনের মুখের দিকে পর পর তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন।
.
আমি হর্ষদার কাছে গেলাম। ছাদে গোটা কুড়ি টবের মাঝে উবু হয়ে হর্ষদা ফুলগাছের পরিচর্যা করছিলেন। আমার কথা শুনতে শুনতে উনি টবের মাটি খুঁড়ে যাচ্ছিলেন একটা শিক দিয়ে। অনেকক্ষণ কথা বললেন না। একটা গোলাপের শুকনো মরা ডাল গাছ থেকে সাবধানে ভেঙে নিয়ে হর্ষদা মৃদু স্বরে বললেন, ”তোর ইচ্ছেটা কী?”
”আমি এখনও ঠিক করতে পারিনি ক্লাব বদল করব কি করব না। নিমাই—আনোয়ারেরও আমার মতন দোটানা অবস্থা। ওরা একবার বলছে, থেকেই যাই, একটা বছর তো! আবার বলছে, ধ্যুত, একটা বছর স্রেফ অযথা নষ্ট করা।”
”প্রসূন, এখন তোর সামনে চ্যালেঞ্জ, নিবি কি নিবি না, সেটা তুই—ই ঠিক কর।”