রতন বল ছাড়ার বদলে নিজেই মাঠ ছাড়ল। পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছিল না। দু—তিনজনে ওকে ধরে মাঠের বাইরে রেখে এল আর ওর জায়গায় নামল টিকাদার। তার পরই রাজস্থান পেনালটি পেল। ওদের লেফট আউট আমাদের দুজনকে কাটিয়ে গোল পোস্টের কাছে এসে ব্যাক সেন্টার করতে যাবে, টিকাদার তার পেটে লাথি মারল। পেনালটি থেকে গোলটা করল সুভাষ।
৪—১ গোলে এগিয়ে থেকে ওরা এবার একটু আলগা দিল। আমি দু’বার বল পেয়েও কিছু করতে পারলাম না। রাইট উইং—এর একটা ক্রস পাস ভলি মেরে বারের উপর দিয়ে পাঠালাম। আর একবার দুজনকে কাটিয়ে সামনেই পড়ল ফেন। পাশে কেউ নেই যে ওয়াল করব। তাড়াতাড়ি পেনালটি বক্সের মাথা থেকেই গোলে মারলাম, অরুণ আঙুলের ডগা দিয়ে বলটা তুলে বারের ওপারে পাঠিয়ে দিল।
আমার তখন নিমাইয়ের কথা মনে হল। নিমাই থাকলে, ওকে বলটা ঠেলেই ডান দিকের পোস্ট—এর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ বরাবর আমার জায়গায় চলে যেতাম। নিমাই ঠিক বলটা পাঠিয়ে দিত আমার এক গজ সামনে। তার পর শরীরটাকে বাঁ দিকে একটু হেলিয়ে ডান পা—টাকে পিছনে এক ফুট তুলে বিদ্যুৎ গতিতে একটি ছোবল।
খেলার শেষ বাঁশি বাজার পর মাঠেই আনোয়ার আর টিকাদারের মধ্যে একটা খণ্ডযুদ্ধ প্রায় বেধে যাচ্ছিল। কারণ সেই পেনালটি। আনোয়ারের মতে, টিকাদার অযথা গোল খাইয়েছে লাথিটা মেরে। লেফট আউট ব্যাক—সেন্টার করতই, কিন্তু তা থেকে গোল নাও হতে পারত, চান্স পাওয়া যেত ক্লিয়ার করার। কিন্তু পেনালটি করিয়ে টিকাদার রাজস্থানকেই শিওর চান্স করিয়ে দিয়েছে।
জবাবে টিকাদার কতকগুলো অশ্রাব্য শব্দ উচ্চচারণ করল, তখন আনোয়ার তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। টিকাদার ভয়ংকর চোখে আনোয়ারের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে, দাঁত চেপে ‘আচ্ছা, দেখা যাবে—’ বলে মাঠ থেকে বেরিয়ে এল।
নিমাই গ্যালারি থেকে নেমে এসেছে। বিপিনদা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘বেশ, বেশ, ভালই খেলেছ।’ রতন আমার দিকে অদ্ভুত চোখে একবার তাকাল। কেমন বিষণ্ণতা আর ভয় ওর চাহনিতে। দুটো টোস্ট আর একটা সিদ্ধ ডিম খেয়ে যখন আমরা তিনজন বাড়ির পথে রওনা হচ্ছি, রতন ইশারায় আমাকে ডাকল।
”তুমি গরিব ঘরের ছেলে, আমিও তাই”, রতন ভারী এবং স্থির স্বরে বলল, ”এখানে টাকা দেয় না, সুতরাং তুমি নিশ্চয়ই পরের বছর অন্য ক্লাবে যাবে। যাবেই, আমি জানি। তোমার খেলা আছে, তুমি এখানে পচে মরবে কেন!”
আমি চুপ করে রইলাম। রতন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ”একটা চাকরি দেবেন বলেছেন বিপিনদা।”
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, ”জানি।”
”তুমি যদি চাকরি চাও, তা হলে বিপিনদা আগে তোমার জন্যই চেষ্টা করবেন। আমি জানি, আজ তোমার খেলা দেখে বুঝতে পেরেছি।” রতনের স্বর হঠাৎ করুণ দুর্বল হয়ে এল। কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে আমার হাতটাও চেপে ধরল, ”চাকরিটা আমার দরকার! আমার বাড়িতে ভীষণ খারাপ অবস্থা, আমার আগে চাকরিটা দরকার, প্রসূন। কথা দাও, তুমি এখানে কিছু চাইবে না। কথা দাও, তুমি এখানে সামনের বছর থাকবে না।”
আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, ”আমি এখানে থাকতে আসিনি। আরও বড় হতে চাই। বড় ক্লাবে যেতে চাই।”
রতন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হাতে চাপ দিয়ে বলল, ”কোথায় যেতে চাও, আমার অনেক চেনা আছে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, এরিয়ান, যুগের যাত্রী?”
”মোহনবাগানে।”
”এখনই? না, আর একটা বছর অন্তত কোথাও কাটাও। তুমি এখনও নেহাতই জুনিয়ার। এখনই অত বড় ক্লাবে যেয়ো না, বসিয়ে রাখবে। এখন একটা বছর নষ্ট হওয়া মানে ভীষণ ক্ষতি। দেখছ না, আমার অবস্থা। লোভে পড়ে বড় ক্লাবে একদিন আমিও গেছলুম। বসিয়ে রেখে দিল। বড় ক্লাবের মোহ ছাড়তে পারলুম না। আশায় আশায় পরের বছরও রইলুম। একটা মাত্র ম্যাচ খেলালে। তাও আধখানা। তার পর উয়াড়ি, তার পর এখানে। আমারও ইচ্ছে ছিল তোমার মতন—আরও বড় হব।”
রতনের স্বর মৃদু হতে হতে গড়ের মাঠের আবছা সন্ধ্যার সঙ্গে মিশে গেল। আমার মনটা ভারী হয়ে উঠল, মাথা নামিয়ে চুপ রইলাম। রতন গাঢ় স্বরে বলল, ”আজ আমি খেলেছি ভয় পেয়ে। তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। টিমে আমার পোজিশন বোধ হয় গেল, এই চিন্তাই শুধু মাথায় ঘুরছিল। কিছু মনে কোরো না!” ও আমার হাতে চাপ দিল। আমি মাথা নাড়লাম।
রতন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”তুমি গোল দাও, অনেক গোল দাও, বড় ক্লাবে যাও। আর শরীরের যত্ন কোরো। আরও ওজন বাড়াতে হবে, আরও খাটতে হবে তোমায়; এজন্য স্বার্থপর হতে হবে, বাড়ির জন্য ভেবে উপোস দিয়ো না, বরং অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে খাবে। গরিবদের নিষ্ঠুর হতে হবে যদি বড় হতে চায়, নয়তো আমার মতন হবে; এই রকম স্বাস্থ্য নিয়ে কি বড় ফুটবলার হওয়া যায়? প্রসূন, দয়ামায়া মমতা বড় ভয়ংকর শত্রু।”
রতন আচমকাই আমাকে ফেলে রেখে টেন্টের মধ্যে চলে গেল। আনোয়ার আর নিমাই অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। কাছে আসতেই ওরা জানতে চাইল, কী কথা হচ্ছিল। আমার মন ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেছিল। বললাম, ”পরে বলব। এমন কিছু সিরিয়াস কথা নয়।” তার পর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, ”হ্যাট্রিক হল না রে, নিমাই।”
”খেলা দেখতে দেখতে ইচ্ছে করছিল রাজস্থানের দিকে নেমে পড়ি। শিওর তা হলে সুভাষের হ্যাট্রিক করিয়ে দিতাম।” নিমাই খুব গম্ভীর হয়ে বলল, ”কীরকম ডিফেনস ভেঙে ঢোকে দেখেছিস?”