চোখ থেকে হাত না সরিয়ে নিমাই বলল, ”মোহনবাগানকে তো?”
”না—” শেষ করার আগেই থেমে গেলাম। হাত নামিয়ে নিমাই জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
বললাম, ”আজকে।”
.
আমি হ্যাট্রিক করতে পারলাম না প্রথম খেলায়। শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাদের ডিফেনডিং জোনে নেমে এসে আমাকে ট্যাকল করতে হল রাজস্থানের হাফ ব্যাকদের। আনোয়ারের দু’ পাশ দিয়ে দুটো ছেলে, সুকল্যাণ আর সুভাষ বেরোচ্ছে। আমরা দশজন পেনালটি বক্সেপনেরো মিনিটের মধ্যে পাঁচ গোল খেয়ে যাওয়ার কথা। সুকল্যাণের ডান পা থেকে বেরোনো রতিনটে গোলার একটা পোস্টে, একটা আনোয়ারের কাঁধে আর অন্যটা কোন জাদুমন্ত্রে জানি না, বারের উপর দিয়ে তুলে দিল গোলকিপার। বাকি দুটো নষ্ট করল সুভাষ নিজেই। তার পর ১৮ মিনিটে কীভাবে যেন একটা বল ছিটকে সেন্টার লাইনের কাছে চলে এল। আমি বলটা ধরে রাজস্থান গোলের দিকে তাকিয়ে দেখি—গোলকিপার আর আমার মাঝে শুধু ওদের স্টপার ব্যাক ফেন।
মাঝ—মাঠ থেকে আমি বল নিয়ে দৌড়োতে শুরু করলাম, একটু কোনাকুনি, ডান দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে। ফেন আমার সঙ্গেই দৌড়চ্ছে, তার বাঁ দিক কভার করে। লেফট ব্যাক নেমে আসছে। বয়স্ক ফেনকে মুখোমুখি কাটাতে পারব বলে ভরসা হল না। স্পিডে হারাব স্থির করেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলটা বাঁ দিকে প্রায় পনেরো গজ ঠেলে দিয়ে ফেনকে ডান দিক থেকে প্রচণ্ড দৌড়ে পিছনে ফেলে দিলাম। পেনালটি বক্স—এর মধ্যে যখন ঢুকছি, গোলকিপার অরুণ তীরবেগে এগিয়ে আসছে! সেই সঙ্গে দু’ পাশ থেকে দুই ব্যাক।
আমি শুধু অরুণের শরীরের ভঙ্গিটা লক্ষ করলাম। লাফ দেবার আগে বেড়াল যেমন করে, সেই রকম শরীরটাকে ধনুকের ছিলার মতন টেনেছে। আমি বাঁ দিকে হেলে যাওয়া মাত্রই ও দু’হাত বাড়িয়ে ভেসে এল। আমি মুহূর্তে ডান দিকে বলটাকে টেনে নিলাম এবং ডান পায়ের নিখুঁত নিচু পানচ—এ ডান পোস্ট ঘেঁষে বলটাকে গোলের মধ্যে পাঠালাম আর সেই সঙ্গেই লেফট ব্যাকের প্রচণ্ড চার্জে মাটিতে ছিটকে পড়লাম।
আমার প্রথম গোল! মাটিতে কাত হয়ে এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটার দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আর জালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বাদামি রঙের ওই গোলাকৃতি বস্তুটা কী নিরীহভাবে বিশ্রাম করছে। আমার সারা পৃথিবী এখন মনে হচ্ছে ওই বলটা। ইচ্ছে করছিল বলটাকে দু’ হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরি।
আমাকে তুলে ধরল দুজনে। রাইট উইং আর রাইট ইনসাইড আনোয়ার। দু’ হাত তুলে ছুটে আসছে। আমার মাথা ঘুরছে তখন। আনোয়ার কী সব বলতে বলতে গালে চুমু খেল। মেম্বার গ্যালারির দিকে তাকালাম। গোটা পঞ্চাশেক লোকও হবে না। মাত্র এই ক’জন সাক্ষী রইল আমার প্রথম গোলের। শোভাবাজারের গোটা টিমটাই আমাকে জড়িয়ে ধরছে, পিঠ চাপড়াচ্ছে। গ্যালারি থেকে কে একজন চিৎকার করে ঠাট্টা করল, ”হয়েছে রে হয়েছে, এবার সেন্টার কর, যেন শিল্ড পাবার গোল দিয়েছিস!” শুনে আমি খুব লজ্জা পেলাম।
দু’ মিনিটের মধ্যেই রাইট উইং—এর ক্রস সেন্টার থেকে সুভাষ হেড করে গোল করল। পরের মিনিটেই আবার একটা একইভাবে হেড করে। হাফ টাইম—এর সময় বিপিনদা এসে উত্তেজিতভাবে আমায় নির্দেশ দিলেন, ”নামবে না তুমি, একদম নামবে না সেন্টার লাইনের এধারে। গোল খাই খাব, তুমি উঠে থাকবে। আর রতন, তুই শুধু বল বাড়াবি।”
রতন হচ্ছে সেই ছেলেটি, প্রথম দিনে যার নাক ফাটতে দেখেছি প্র্যাকটিসের সময়, আর যাকে বিপিনদা একটা চাকরি দেবেন বলেছেন। রতন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ক্লান্ত শরীরটা মাটিতে শুইয়ে চোখ বুজল।
একটা অ্যালুমিনিয়ামের গেলাশ আর এক বালতি জল। একজন জল খেয়ে গেলাশটা আর একজনের হাতে দিচ্ছে, সে বালতিতে ডুবিয়ে জল তুলে খাচ্ছে। গেলাশের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন টিকাদার বলল, ”খাওয়াচ্ছিস তো আজ!”
”কেন?” বিরক্ত হয়ে বললাম।
”সিজনে শোভাবাজারের প্রথম গোল স্কোর করলি!”
আমি ফিকে হেসে জলের গেলাশের জন্য হাত বাড়ালাম। টিকাদার বলল, ”টিমে আমার জায়গাটা তো খেলি, কমপেনসেট করবি না?”
শুনে আমার ভালই লাগল। বললাম, ”আজ নয়, আর একদিন।”
মাঠে নামবার আগে একবার গ্যালারির দিকে তাকালাম। একেবারে মাথায় এক কোণে কুঁজো হয়ে নিমাই বসে। ওকে আমরা টেন্টের মধ্যে শুইয়ে রেখে বেরিয়েছিলাম। আমায় তাকাতে দেখে চট করে ও হাত তুলল। দেখলাম হাতের আগায় তিনটে আঙুল উঠে রয়েছে।
সুভাষের হ্যাট্রিকের জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে ওরা আরও দুটো গোল নষ্ট করার পর সুকল্যাণ হঠাৎ একটা গোল করে মুষড়ে পড়ল। ও বুঝতেই পারেনি পনেরো গজ দূর থেকে মারা বলটা বিনা বাধায় গোলে ঢুকে যাবে। সুভাষ বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের ঘুষি মেরে রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে ফিরে গেল এবং দু’ মিনিটের মধ্যেই আনোয়ারকে ছিটকে ফেলে দিল শোল্ডার চার্জে।
আমার কিন্তু অবাক লাগল রতনকে। বিপিনদার নির্দেশই শুধু নয়, ও যেন নিজের দলের বাকিদের কথাও ভুলে গেছে। বল পেয়ে ও একাই ছুটছে। আমি চেঁচাচ্ছি বলের জন্য, কিন্তু রতন কানেই নেয় না। জিরজিরে বুকটা হাপরের মতন ওঠানামা করছে, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে, মুখ লাল, ঘাম গড়াচ্ছে রগ বেয়ে থুতনি পর্যন্ত। তবু রতন তাড়া করছে, বল ধরে আবার একাই এগোচ্ছে এবং যথারীতি ওর পা থেকে বল ওরা কেড়ে নিচ্ছে। কিছু যেন ভর করেছে ওকে, সারা মাঠ চষছে, কিন্তু বোকার মতন, অযথা। আমি অধৈর্য, বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। মাঠের বাইরে থেকে বিপিনদার চিৎকার কানে এল, ”বল ছাড়, রতন! বল ছাড়, প্রসূনকে দে!”