বলটা রাস্তার দিকে যেতেই নীলিমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। ও হাসল। আমি বললাম, ‘স্কুল থেকে?” ও ঘাড় নাড়ল। মুখটা শুকনো। কপালে কয়েকটা চুল ঘামে সেঁটে রয়েছে। আঁচল দিয়ে গলা ও ঘাড়ের ঘাম মুছল।
”আমার স্কুল বসবে বিকেলে!” বলে আমি হেসে উঠলাম।
”তাই বুঝি পড়া তৈরি করছ?” নীলিমার সাজানো দাঁতগুলো ঝকঝকে করে উঠল।
”আমি খুব খারাপ ছাত্র, প্রমোশন পাব কি না জানি না!” হতাশার ভান করে বললাম।
”খাটলে পাশ করবেই করবে।”
নীলিমার স্বরে, চোখে, এমনকী দাঁড়াবার ভঙ্গিতে আর পরিহাস নই। আমার ভিতরে আলতোভাবে একটা প্রত্যয় পাখির মতন ডানা মেলে ভেসে এল। হাতের বলটাকে হঠাৎ কিক করে সোজা শূন্যে তুলে দিলাম। পিন্টু চিৎকার করে উঠল, ”তিন।”
একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে ফেললাম। চিত হয়ে মাটিতে শুয়ে বলটাকে ব্যাক ভলি করলাম। এভাবে জীবনে কখনও মারিনি। আশ্চর্য, আশ্চর্য, তিন নম্বর টারগেটের মাঝখানে বলটা দুম করে লেগে ফিরে এল। পিন্টু দু’ হাত তুলে চিৎকার করে বলটার পিছু ধাওয়া করল। নীলিমার বড় বড় চোখ দুটো আরও বড় হয়ে গেছে, আর আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমিই প্রসূন ভটচাজ কি না!
”দাদা আর একবার।” পিন্টু আমার কাছে বলটা পাঠিয়ে দিয়ে বলল।
ভালভাবেই জানি, ব্যাপারটা আন্দাজে এবং ভাগ্যের জোরে হয়ে গেছে। আর একবার করতে গেলে, কারখানার চালার উপর দিয়ে বল উড়ে যাবে কি রাস্তার ওপরে পড়বে, তা ভগবানও জানে না।
”হাঁটুতে একটা চোট আছে, এখনও ভাল করে সারেনি।” নীলিমাকে বললাম, ”ফট করে যদি লেগে যায়…”
”না না, আর করতে হবে না!” নীলিমা ব্যস্ত হয়ে বলল।
”আর একবার মারি।”
”না না, আগে পুরোপুরি সারুক।” নীলিমা হাত তুলে বারণ করল। আমি হাঁফ ছাড়লাম। স্ট্রাইকারকে আটকাতে ছোটখাটো ফাউল করাটা খেলার মধ্যেই পড়ে।
”বড্ড খিদে পেয়েছে।” পেটে হাত দিয়ে চোখ মুখ করুণ করে তুললাম। আমি জানি, নীলিমার সঙ্গে ছোট্ট একটা প্লাসটিকের পয়সা রাখার ব্যাগ সব সময় থাকে।
”অমনি খিদে পেয়ে গেল, পড়া শুরু করতে না করতেই!” দু’ আঙুলে ব্লাউজের মধ্যে থেকে ব্যাগটা বার করতে করতে নীলিমা ধমকে উঠল। খুট করে ব্যাগের বোতামটা খুলে ও বলল, ”বেশি নেই, তিরিশটা পয়সা বড়জোর দিতে পারি।”
”মোটে তিরিশ! এমন একটা ব্যাক ভলি দেখালাম!”
”আচ্ছা, পঁয়ত্রিশ।”
”না, না, প্লিজ, আট আনা করো। বদুর দোকানে চারটে কচুরি আর দুটো জিলিপি। ভীষণ খিদে!”
এবার আর ভান নয়। আন্তরিকতার সঙ্গেই বললাম। নীলিমা আমার মুখ দেখেই বুঝল এবং একটি আধুলি দিল।
”ধার রইল।”
”এই নিয়ে কত হল?” গম্ভীর হয়ে নীলিমা বলল।
”হিসেব রেখো, সব একবারে শোধ করে দেব।”
নীলিমা বাড়ি চলে গেল। গত এক বছরে অন্তত পঞ্চাশ—ষাট টাকা এইভাবে ওর কাছ থেকে নিয়েছি। প্রতিবারই বলেছি, লিখে রেখো, সব শোধ দিয়ে দেব। নিশ্চয়ই দেব। আমার এই পরিশ্রম বৃথা যাবে না, যেতে দেব না।
পয়সা হাতে আসতেই খিদেটা চনচনে হয়ে চাড়া দিল। বলটা পিন্টুকে দিয়ে বললাম, ”বাড়ি চলে যা।”
”আর খেলা উচিত নয়। চোটটা আবার চাগিয়ে উঠতে পারে।” বিজ্ঞের মতন পিন্টু আমাকে উপদেশ দিল। হাসি পেলেও হাসলাম না আমি। পিন্টু বল নিয়ে ধাপাতে ধাপাতে চলে গেল।
মিনিট পনেরো পরে বদুর দোকানে গরম কচুরি আর জিলিপি খেয়ে জলের গ্লাসটা হাতে নিয়েই মনে পড়ল, পিন্টুরও খাওয়া হয়নি আজ। পাথর হয়ে গেল আমার সর্বাঙ্গ। শুধু পেটের মধ্যেটা মুচড়ে উঠল।
.
।।৮।।
আমি আর পলাশ টিকাদার পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আবার আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশের উত্তর আর পুব নীলে—ধূসরে মাখা। কিন্তু দক্ষিণ—পশ্চিমে গাঢ় কালো মেঘ। বাতাস বইছে না। ভ্যাপসা গরমে আমরা ঘামছি। বৃষ্টি হবে কি হবে না, বোঝা যাচ্ছে না। আমার প্রথম খেলার ভাগ্য লেখা রয়েছে আকাশে।
ঠাণ্ডা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। মেঘটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে—তার একটা কোণ মহমেডান মাঠের দিকে। টিকাদারের মুখ খুশিতে ভরে উঠল। বুট পরার জন্য সে টেন্টের ভিতরে চলে গেল। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঘটা ছড়াচ্ছে পশ্চিম দিকে, হাওয়া বইছে পশ্চিমে। হাঁফ ছাড়লাম।
বুট পরে টেন্ট থেকে বেরিয়ে টিকাদার আকাশে তাকিয়েই বিরক্ত হল। আমার মুখে ক্ষীণ হাসি দেখে সে আবার টেন্টে ঢুকে গেল। এর দশ মিনিট পরেই এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে ভেসে পালাল একটা ছোট্ট মেঘ। আমি বুট হাতে শুকনো মুখে টেন্টের এক কোণে দাঁড়িয়ে। নিমাই বুট পরতে পরতে আমাকে লক্ষ করছিল। কাছে এসে বলল, ”খেলবি আজ?” জবাব না দিয়ে আমি মুখ ঘুরিয়ে টেন্টের বাইরে চলে গেলাম।
মিনিট পাঁচেক পরই বিপিনদা ব্যস্ত হয়ে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন!
”কাণ্ড দ্যাখো তো, খেলার ঠিক আগেই বমি শুরু হল। প্রসূন কোথায়, প্রসূন … এই যে দ্যাখো তো নিমাইয়ের কাণ্ড! যাও, যাও ড্রেস করো।”
বেঞ্চে নিমাই শুয়ে। হাত দিয়ে চোখ ঢাকা। হঠাৎ নাকি বমি করতে শুরু করেছে। ড্রেস করে বেরোবার সময় আনোয়ারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ”কী হল রে?”
নির্বিকার ভাবে আনোয়ার বলল, ”আধ শিশি আইডিন খেলে বমি তো হবেই।”
শোনামাত্র বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। শুধু বললাম, ”বাঙালটা সব পারে।” নিমাইয়ের কাছে গিয়ে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম, ”গুনে গুনে তিনটে গোল দেব।”