- বইয়ের নামঃ কিশোর সাহিত্য সমগ্র ১ম খণ্ড
- লেখকের নামঃ মতি নন্দী
- প্রকাশনাঃ দীপ প্রকাশন (ভারত)
- বিভাগসমূহঃসমগ্র
স্ট্রাইকার
স্ট্রাইকার – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস
।।১।।
কাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।
আমাদের গলিটা এঁকেবেঁকে তিনটে মোড় ঘুরে যেখানে বড় রাস্তায় পড়েছে, একটা বিরাট সাদা মোটর গাড়ি সেখানে এসে থামল। অত বড় গাড়ি আমাদের পাড়ার লোকেরা কখনও দ্যাখেনি। তাই তারা ভিড় করে গাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল কুচকুচে কালো এক মধ্যবয়সী বিদেশি। মুখে চুরুট, চোখে কালো চশমা, গাড়ির রঙের মতনই পরনে সাদা কোট ও ট্রাউজারস। চুল কাঁচা—পাকায় মেশা।
ভিড়ের দিকে তাকিয়ে, বিদেশি হাত নেড়ে পোর্তুগিজ ভাষায় কী বলল। আমার পাড়ার লোকেরা বাংলা এবং একটুআধটু ইংরেজি, হিন্দি আর ওড়িয়া ছাড়া কোনও ভাষা বোঝে না। তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। বিদেশি আবার কথা বলল। কথার ভঙ্গিতে বোঝা যায়, কিছু একটা জানতে চাইছে বা খোঁজ করছে।
ভিড় থেকে নুটুদা এগিয়ে গেলেন, ”কেয়া মাঙতা, কী চাই?” তারপর মনে মনে কয়েকটা কথা তর্জমা করে বললেন, ”হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?”
এবার বিদেশি পরিষ্কার বাংলায় বলল, ”প্রসূন ভট্টাচার্য নামে একটি ছেলে কি এই রাস্তায় বাস করে?”
বিদেশির মুখে বাংলা শুনে ওরা থতমত হয়ে অবাক হল, ভরসাও পেল। সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলে ভনভন করে বলে উঠল—প্রসূন? প্রসূন! প্রসূন!! কী দরকার? কেন এসেছে লোকটা?
”প্রসূন, মানে অনিল ভটচাজের বড় ছেলে?”
”হ্যাঁ, তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।” বিদেশি আশ্বস্ত হয়ে নুটুদাকে বলল। নুটুদা আমাদেরই পাশের ঘরের আর এক ভাড়াটে। ছাপাখানায় কমপোজিটরের কাজ করেন। বছর দুয়েক আগে ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন। সংসারে একমাত্র মেয়ে নীলিমা ছাড়া আর কেউ নেই। মানুষটি অতি সরল, সাদামাটা। দোষের মধ্যে অযাচিত উপদেশ দেন; বারোয়ারি একটা কিছুর, রবীন্দ্রজয়ন্তী বা শীতলা পুজোর সুযোগ পেলেই চাঁদা তুলতে শুরু করেন। ছেলে—বুড়ো সবাই ওঁকে ‘নুটুদা’ বলে ডাকে। নীলিমা প্রায় আমারই বয়সী। ক্লাস টেন—এ পড়ে, সারাদিন পরিশ্রম করে ঘরে—বাইরে। ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব।
নুটুদা সন্দিহান চোখে সেই বিদেশিকে বললেন, ”প্রসূনের সঙ্গে কেন দেখা করবেন?”
বিদেশির চুরুটটা নিভে গেছিল। লাইটার জ্বেলে সেটা ধরাতে ধরাতে বলল, ”আমি ব্রাজিল থেকে আসছি। স্যানটোস ফুটবল ক্লাবের নাম শুনেছেন বোধ হয়। আমি সেই ক্লাবের ম্যানেজার। প্রসূন যদি রাজি হয়, আমরা ওকে নেব।”
নুটুদা বললেন, ”নেবেন মানে?”
বিদেশি ব্যস্ত হয়ে বলল, ”এজন্য নিশ্চয়ই টাকা দেবে আমার ক্লাব। বছরে একবার বাড়ি আসার প্লেন ভাড়াও।”
”কত টাকা দেবেন শুনি?”
বিদেশি সতর্কভাবে বলল, ”সেটা ওর বাবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করব। প্রসূন তো এখনও নাবালক। আমরা সব খবর সংগ্রহ করেছি। ওর বয়স এখন সতেরো বছর চার মাস।”
নুটুদা বিদেশিকে নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পিছনে পাড়ার লোকের মিছিল। আমাদের বাড়িতে যেতে হলে আড়াই হাত চওড়া একটা মাটির গলিতে ঢুকতে হয়। একতলায় আমরা আর নুটুদারা ভাড়া থাকি দেড়খানা করে ঘর নিয়ে। দোতলায় থাকে বাড়িওয়ালা বিশ্বনাথ দত্ত। তার চার মেয়ে। দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে।
বিশ্বনাথ বা বিশুবাবু বাড়ি থেকে তখন বের হচ্ছিলেন, হঠাৎ একজন বিদেশির পিছনে সারা পাড়ার লোককে গলিতে ঢুকতে দেখে ভড়কে গেলেন। তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে ঢুকে সেজো মেয়ে সোনামুখীকে পাঠিয়ে দিলেন। বিশুবাবুর পুলিশকে ভীষণ ভয়।
বাবা ঘরে চৌকিতে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মা রান্নাঘরে। আমরা দুই ভাই এক বোন। আমার পর পিন্টু, তার পর পুতুল। নুটুদা বাড়িতে ঢুকেই ”অনিলবাবু! অনিলবাবু!” —বলে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে শুরু করলেন। বাবা গম্ভীর প্রকৃতির, অত্যন্ত কম কথা বলেন। অধিকাংশ দিন আমার সঙ্গে তো একটাও কথা হয় না। আমি ওঁকে এড়িয়ে চলি।
”অনিলবাবু, সন্তাোষ ক্লাবের ম্যানেজার এসেছে!” নুটুদা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন। ”জানেন তো, পেলে ওই ক্লাবের প্লেয়ার!”
”কে পেলে?’ বাবা ভারী গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, ”কোথায় বাড়ি?”
নুটুদা থতমত হয়ে গেলেন। বিদেশি মৃদু হেসে এগিয়ে এসে বলল, ”স্যানটোস ক্লাব ব্রাজিলে। স্যানটোস খুব নামকরা বন্দর, সেখান থেকে কফি চালান যায় সারা পৃথিবীতে। আমাদের ক্লাব পৃথিবীর সেরা ক্লাবগুলোর একটা। পেলে পৃথিবীর সেরা ফুটবলার। অত বড় গুণী প্লেয়ার এখনও দেখা যায়নি।”
বাবা পিছনের ভিড়ের উপর আলতোভাবে চোখ বুলিয়ে বললেন, ”আমি ফুটবলের কোনও খবর রাখি না। আপনার কী প্রয়োজন, বলুন।”
”আপনার ছেলে প্রসূনকে আমাদের ক্লাবে খেলাতে চাই।”
”প্রসূনের সঙ্গে কথা বলুন। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।” বাবা এই বলেই ঘরে ঢুকে গেলেন। বিদেশিও সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল এবং পিছনে নুটুবাবু। বিশুবাবু ইতিমধ্যে পুলিশ নয় জেনে এগিয়ে এসে আমাদের ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন।
বিদেশি বলল, ”প্রসূন নাবালক, ও তো কনট্রাক্ট সই করতে পারবে না, ওর অভিভাবক হিসেবে আপনাকেই তা করতে হবে।”