”হ্যাঁ।”
”সঙ্গে কে, মলয়া?”
”বোধহয়।” সত্যশেখর গম্ভীরস্বরে বলল।
”হরি কলা দেখাল… আমি স্পষ্ট দেখেছি। বোধহয় আমাদের বাঁদর বলে গেল।”
রাজশেখর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ”একটা লোক ডাব বেচছে, দেখ তেষ্টা পেয়ে গেল।”
”দাদু, ফ্লাস্কে তো জল রয়েছে।”
‘কর্পোরেশনের জলে আর প্রকৃতির জলে অনেক তফাত।”
রাজশেখরের সঙ্গে তাঁরা হেঁটে খানিকটা পিছিয়ে এল যেখানে গণ্ডাচারেক ডাব নিয়ে একটা লোক বসে আছে।
ডাবের জল খেয়ে মিনিট দশ পর ওরা আবার রওনা হল। দিল্লি রোড ধরে এল দিয়াড়া মোড়। এরপর নসিবপুর, সিঙ্গুর হয়ে কামারকুণ্ডু। ঘড়ি দেখে সময় হিসাব করে রাজশেখর বললেন, ”খেলা শুরুর আগেই আমরা পৌঁছে যাব।”
দু’ধারে মাঠ, দূরে গাছপালার আড়ালে গ্রাম। সাইকেল আরোহী, পথচারী, মাঝে মাঝে যাত্রীভরা বাস আর ট্রাক ছাড়া পথে আর কিছুর সঙ্গে তাদের দেখা হল না।
রাস্তাটা এক জায়গায় ভাঙা। বড় বড় গর্তগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো সরু পথ রয়েছে। কুমড়ো বোঝাই একটা সাইকেল ভ্যান সরু পথটা দিয়ে আসছে। সত্যশেখর গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করল।
”কাকা, এইবার আমাকে দাও।”
”এটা পেরিয়ে গিয়ে।”
ভ্যানটা চলে যাবার পর গাড়িকে সন্তর্পণে ভাঙা জায়গার পাশ কাটিয়ে এনে সত্যশেখর নামল। কলাবতী স্টিয়ারিংয়ে বসল।
আধ কিলোমিটার পরেই বর্শাফলার মতো রাস্তাটা বেঁকে গেছে। কলাবতী একটা গোরুর গাড়িকে পাশ কাটিয়ে বাঁক ঘুরেই অচল সবুজ অ্যাম্বাসাডারের ঘাড়ে ফিয়াটকে নিয়ে ফেলত, যদি না তার কাকা পা বাড়িয়ে ব্রেকটা চেপে ধরত।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে মলয়া এবং হরিশঙ্কর। ড্রাইভার বনেট খুলে মুখ নামিয়ে কী করছে।
”শার্প বেণ্ডের মুখে এভাবে কেউ গাড়ি রাখে?” সত্যশেখর গলা বাড়িয়ে বলল, ”এখুনি একটা কাণ্ড ঘটে যেত।”
রাজশেখর গাড়ি থেকে নামলেন বেশ প্রসন্নমুখে। একটু দূরে গাছতলায় দাঁড়ানো হরিশঙ্করের কাছে গিয়ে কোমরে হাত রেখে এক মিনিট সেইভাবে তাকালেন, নতুন ব্যাটসম্যান ক্রিজে এসে যেভাবে সাজানো ফিল্ড পর্যবেক্ষণ করে। তারপর পিচে ব্যাট ঠুকে ঠুকে আর কাঁকরধুলো বাছাবাছি করে বাগান করার মতো ভঙ্গিতে বললেন, ”খেলা দেখতে যাচ্ছিস?”
”হ্যাঁ, তুই?”
”খেলতে।”
হরিশঙ্করের চোখদুটো এবার বড় হয়েই ভ্রূ কুঁচকে গেল। রাজশেখরের সাদা ট্রাউজার্স আর শার্টের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ”হারবি।”
”বাজি!”
”বাজি।”
কলাবতী গাড়ি থেকে নেমে এসে মলয়ার দিকে এগোচ্ছিল, থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ”এক কাঁদি মর্তমান কলা।”
”সিংহরা এখন তাহলে নিরিমিষ্যি খাচ্ছে?”
হরিশঙ্করের বাঁকানো হাসির দিকে তাকিয়ে রাজশেখর বললেন, ”খাচ্ছে আর খাওয়াবে ভাবছে।”
ড্রাইভারের সঙ্গে মলয়াও উঁকি দিয়ে দেখার ভান করছিল, তার কাঁধের থেকে ঝুলছে নিক্কন ক্যামেরা। কলাবতী এসে বলল, ”বড়দি, কী হল?”
”ফ্যানবেল্ট ছিঁড়ে গেছে। সঙ্গে একস্ট্রাও নেই যে…”
সত্যশেখর গাড়ি থেকে নামেনি। সে চেঁচিয়ে বলল, ”কালু, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের, ঠিক সময়ে পৌঁছতে হবে।”
কলাবতী ছুটে এল। ”কাকা, ফ্যানবেল্ট ছিঁড়ে গেছে।”
”তা আমরা কী করব, ওঠ এখন, দাদুকে ডাক।”
”ওঁরা যাবেন কী করে?”
”হেঁটে, নয়তো অপেক্ষা করুক, যখন বাস আসবে উঠবে।”
‘যযআহ, এইরকম নির্জন জায়গায় ওরা পড়ে থাকবেন, তাই কি হয়? আমাদের গাড়িতে ওঁদের উঠিয়ে নাও।”
”বাঁদরদের গাড়িতে ওরা কি চড়বে?”
”এখন রাখো তো ওসব কথা, বিপদে পড়েছে না?” কলাবতী কাকাকে প্রায় ধমকে দিল। তারপর সে চেঁচিয়ে বলল, ”দাদু, ওঁরা আমাদের সঙ্গে চলুন।”
রাজশেখর এগিয়ে এলেন। ”আমিও তাই হরিকে বলছি, ড্রাইভার তারকেশ্বরে নেমে ফ্যানবেল্ট কিনে, বাসে এখানে ফিরে এসে যা করার করুক। আর তোদের আমরা বকদিঘিতে নামিয়ে দিচ্ছি। চেপেচুপে এঁটে যাবে, কী বলিস?”
”ছ’জন কেন ধরবে না? বড়দি, চলে আসুন।”
গম্ভীর মুখে মলয়া পিছনের আসনে বসল। গাড়ি স্টার্ট দেবার সময় কলাবতীর মনে হল কাকা আয়না দিয়ে পিছনে তাকাল আর জিবটা বার করতে গিয়েও করল না, শুধু বলল, ”পিছনের ডানদিকের অ্যাবজর্বারটা কাল একবার চেক করিয়ে নিতে হবে।”
”কেন, খারাপ হয়েছে?”
‘হবে।”
গাড়ির ডানদিকেই মলয়া বসেছে। তার মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গেল।
তারকেশ্বরে ড্রাইভারকে আর বকদিঘিতে দু’জনকে নামিয়ে ওরা আটঘরার ফুটবল মাঠে যখন পৌঁছল, খেলা শুরু হতে তখন কুড়ি মিনিট বাকি। বকদিঘির অধিনায়ক পতু মুখুজ্জে অপেক্ষা করছে টস করার জন্য।
”এসে গেছে, এসে গেছে, আমাদের ক্যাপ্টেন এসে গেছে।”
শোরগোলে পড়ে গেল মাঠের পুবদিকে নীল শামিয়ানার চারধারে। কলাবতী এই প্রথম এসেছে, তাই প্রচণ্ড ভিড় আর উদ্দীপনা দেখে সে তো অবাক।
মাঠের পশ্চিমে হলুদ রঙের আর একটা শামিয়ানা। ওটা বকদিঘির। মাঠের ধারে মাঝামাঝি জায়গায় পাঁচ হাত লম্বা, আড়াই হাত চওড়া একটা টেলিগ্রাফিক স্কোরবোর্ড আট হাত উঁচু বাঁশের মাচায় বসানো। তার নীচে স্কোরারদের টেবল।
দুটো শামিয়ানাই আকারে ও প্রকারে দেখতে একইরকম। পক্ষপাতিত্বের দোষ কোনোক্রমেই দেওয়া যাবে না। শামিয়ানার সামনের দিকে কিছু চেয়ার প্লেয়ারদের জন্য। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের বাড়ি থেকে চেয়ে এনে এবার একটা সোফা রাখা হয়েছে রাজশেখরের জন্য। পিছন দিকে কাপড়ে ঘেরা একটি ঘর—ড্রেসিং—রুম। তার দরজায় পর্দা ঝুলছে। এবার জলপানের বিরতির সময় মাঠে জল নিয়ে যাবার জন্য স্টিলের জগ ও ট্রে আর ফুল আঁকা কাচের গ্লাস দিয়েছেন দারোগাবাবু।