”দাদু তোমার বিচারবোধের এই মুহূর্তে চটপট একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার।”
”এসে গেছি। তুই এখন ঘুমোতে যাবি।”
”কারেক্ট ডিসিশন। কিন্তু তুমি ম্যাচটা খেলার যে সিদ্ধান্ত…”
”ওটা পাকা। তিন পুরুষের যদি না হয়, দু—পুরুষের খেলার রেকর্ডটা তো করে রাখি। আটঘরায় কালই পরমেশ, মতি, নন্তুদের চিঠি দিচ্ছি।”
কলাবতী যখন উঠে চলে যাচ্ছে, রাজশেখর পিছন থেকে বললেন, ”তোর আগামী দুষ্টুমির প্রোগ্রাম কী?”
”স্কুলের স্পোর্টসে… আমাদের ক্লাসের সুস্মিতার সঙ্গে একটু পরামর্শ করা দরকার।”
লেডিজ পার্কের গায়েই সুস্মিতাদের বাড়ি। দুজনের দিন—দুয়েক চাপা আলোচনা হয়। এরপরই স্পোর্টসের গো অ্যাজ ইউ লাইকে মস্তানবেশে কলাবতীর আবির্ভাব। সেদিন সে ছুটে পার্ক থেকে বেরিয়ে সুস্মিতার বাড়িতে গিয়ে মস্তানের ছদ্মবেশ খুলে ফেলে। চুড়িদার ও কমিজ পরাই ছিল প্যান্ট—শার্টের নীচে। তারপর সে আবার ভালমানুষের মতো পার্কে ফিরে আসে।
সুস্মিতাদের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সেরে বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে সে দাদুর কাছে শুনল আটঘরা থেকে পরমেশ এসেছিল। টিম একটা মোটামুটি হয়ে গেছে। গতবছর যারা খেলেছে, তারাই খেলবে, তবে রাজশেখর ও সত্যশেখরের জন্য কোন দুজন বাদ পড়বে তাই নিয়ে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে।
”পরমেশ বলছে দারোগাবাবু, ব্যাঙ্ক—ম্যানেজার আর হেডমাস্টার খেলতে চায়, এরা সবাই নতুন। গোপীনাথ ঘোষ একসময় পার্লামেন্টের মেম্বার ছিল, জানিয়েছে তার ছোট ছেলের খুবই খেলার ইচ্ছে, ছেলেটি কলকাতায়ই বরাবর রয়েছে, সে নাকি কখনো আটঘরা দেখেনি, তাই… গোপীনাথ তো এখন এম.এল.এ, ওকে চটানো ঠিক হবে না।”
”দাদু এই ম্যাচে খেলার এলিজিবিলিটি তো আটঘরা বা বকদিঘিতে তেরাত্তির বাস, তা গোপীনাথ ঘোষের ছেলে কি তিন রাত কাটিয়েছে?”
”পরমেশ তো বলল কাটিয়েছে। তেরো বছর আগে গোপী ঘোষ যখন এম পি ছিল, তখন একবার আম্পায়ার হয়েছিল। ওখানকার লোকেরা আজও বলে আমপায়ারিং তো নয়, হয়েছিল গোপী ঘোষের ‘এমপিয়ারিং’। সেই সময় গোপী ঘোষের সঙ্গে ওর তিন বছর বয়সী ছেলেটি নাকি আটঘরায় গেছল আর দিন পাঁচেক তার পিসির বাড়িতে ছিলও। সে প্রমাণ নাকি আছে খেলার পর তোলা গ্রুপ ফোটোতে।”
”তাহলে কারা বাদ যাবে?”
”নন্তু আর মতিকেই শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হবে, ওরা নিজেদের লোক কিছু মনে করবে না। কিন্তু বকু বোস, ভুবনেশ্বর সিংহি বা তার কম্পাউণ্ডার চণ্ডীকে বাদ দিলে তো বিক্ষোভ মিছিল, ঘেরাও, অবস্থান, প্রতিরোধ, আর কীসব যেন হয়, তাই হয়ে যাবে। ওরা বহু যুদ্ধের হিরো তো!”
”কিন্তু তোমার তিন পুরুষ খেলার রেকর্ড গড়ার কী হবে?”
রাজশেখর বিমর্ষ থেকে আরো বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। মাথা চুলকোনো শুরু করতেই কলাবতী বলল, ”বুঝেছি, আমার খেলায় আপত্তি হবে।”
”মানে, পরমেশ বলল মতিকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার, ও তো ক্রিকেটের আইনকানুনের বই বাংলায় লিখেছে, ব্যাপারটা বোঝে। ফোন করা হল মতির অফিসে। সে বলল, আইনে কিছু বলা নেই যে পুরুষ টিমে, কোনো মেয়ে খেলতে পারবে না। কিন্তু এরকম নজিরও তো কোথাও পাচ্ছি না, তবে বকদিঘি যদি রাজি হয়…। তাই পরমেশ বলল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে পতু মুখুজ্জেকে একবার সাউণ্ড করে দেখবে, পতুই তো বকদিঘির সব, ক্রিকেট আইন নাকি ভালই জানে টানে।”
”আইনে যদি কিছু বলা না থাকে তাহলে আমি খেলতে পারব না কেন?”
কলাবতী গোঁয়ারের মতো ঘাড় বেঁকাল।
”ক্রিকেট আইনে অনেক কিছুই বলা নেই। হতে হতে, চলতে চলতে সেগুলো প্রথায় দাঁড়িয়ে যায়। এই ধর পোশাকের ব্যাপারটা, সাদা শার্ট—ট্রাউজার্স গোড়া থেকে চলে আসছে তাই ওটাই প্রথা হয়ে গেছে। ছাপকা ছাপকা রঙিন জামা কি কেউ পরে, না পরার দাবি তুলেছে? আবার প্রয়োজনেও অনেক কিছু হয়। কেউ দশ বছর আগেও হেলমেট পরত না, কিন্তু এখন অনেকেই পরছে। তোর সম্পর্কে আপত্তি যদি হয় তো … সেইরকম আর কী।”
কলাবতী চুপ করে রইল। কিন্তু মনে—মনে সে যেন তখন কিছু একটা ভেবে চলেছে। রাজশেখর মিটমিট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ”মনে হচ্ছে কালুর মাথায় দুষ্টুমি ঘুরপাক খাচ্ছে।”
ছেলেটাকে যেন চেনাচেনা লাগছে
ফিয়াট গাড়ি চালাচ্ছে সত্যশেখর। তার পাশে কলাবতী। পিছনের আসনে রাজশেখর। ওরা যাচ্ছে আটঘরায়। পৌঁছতে ঘণ্টা দুয়েকও লাগবে না। গাড়ির পিছনে বুটিতে আছে একটা সুটকেশ আর ব্যাটিং সরঞ্জাম। দর্জি তিন দিনের মধ্যে দুজনের শার্ট আর ট্রাউজার্স বানিয়ে দিয়েছে। মাপমতো বুট দোকানেই পাওয়া গেছে। কলাবতীর সবই আছে, নতুন কিছুর দরকার হয়নি।
দক্ষিণেশ্বরে বিবেকানন্দ সেতুর উপর পিছনে আর একটা গাড়ির হর্ন শুনে সত্যশেখর আয়নায় তাকিয়ে দেখল সবুজ একটা অ্যাম্বাসাডার অধৈর্য হয়ে পথ দেবার জন্য ফাঁক খুঁজছে আর হর্ন দিচ্ছে। ভ্রূ কুঁচকে উঠল সত্যশেখরের। নিজের গাড়ি রাস্তার মাঝখানে এনে গতি মন্থর করল। কলাবতী জানলা দিয়ে পিছনে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলল, ”কাকা, বড়দিরাও যাচ্ছেন।”
”তাই নাকি!”
বিস্ময়টা বাড়াবাড়ি রকমের হওয়ায় সে বুঝে গেল, কাকা ইচ্ছে করেই অ্যাম্বাসাডারকে জব্দ করতে চাইছে।
কিন্তু মিনিট কয়েক পরেই রাজশেখর উত্তেজিত হয়ে বললেন, ”থামা, থামা!”
সত্যশেখর হকচকিয়ে রাস্তার কিনারে এনে মোটর থামাতেই অ্যাম্বাসাডারটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় কলাবতী দেখল পিছনের আসনে বসা বড়দি ঝুঁকে কটমটিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে, আর তাঁর পাশে দাদুর মতো চেহারার এক বৃদ্ধ বুড়ো আঙুল তুলে তাদের কলা দেখালেন। ”হরি গেল না?”