রাজশেখর গুম হয়ে গেলেন। সত্যশেখর আমতা—আমতা করে বলল, ”শালটার যে হিস্টরিক ভ্যালু আছে তা আমি জানব কী করে?”
”তা বটে। তবে হরির ঠাকুর্দা যখন ওয়াজিদ আলি শাহের মেহফিলে বসে নাচ গান আর শায়ের শুনছে তখন আমার ঠাকুর্দা নাটোরের টিমে ক্রিকেট খেলছে।”
এই বলে রাজশেখর গর্বিত চোখে কলাবতীর পিছনের দেয়ালে তাকালেন। ওখানে ক্রিকেট ব্যাট হাতে বলেন্দ্রশেখরের অয়েল পেইন্টিং ঝুলছে। ‘ডবলু জি’—র মতো মুখ ভরতি দাড়ি। মাথায় কাউন্টি ক্যাপ। কোমরে বেল্টের বদলে কালো কাপড়ের পট্টি। হাঁটুর নীচে ছোট প্যাড। ভুঁড়িতেই শুধু ডবলু জি—র এক ষষ্ঠাংশ অনুপস্থিত। এর পাশে, হুবহু রঞ্জির মতো গোঁফওয়ালা, অ্যালবার্ট চুল, ফুল—হাতা জামাপরা ছিপছিপে সোমেন্দ্রশেখর। লেগ গ্লান্স করছেন। কলাবতীর দৃঢ় ধারণা গ্রেস ও রঞ্জির ছবি সামনে রেখে আর্টিস্ট মুখটুকু বাদে বাকি সব এঁকেছে।
”আমাদের হল ক্রিকেটিং ফ্যামিলি। ক্রিকেট ইজ দ্য নোবলেস্ট স্পোর্ট অব অল। শুধু মাঠেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ক্রিকেটকে পাবে… ফর লাইফ ইজ এ গেম, আফটার অল—টু আস, স্পোর্টসমেন, অ্যাট অল ইভেন্টস।”
কলাবতী খুকখুক করে উঠল। রাজশেখর চকিতে তার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কোঁচকালেন।
”ওহ, ইয়েস ইয়েস, ভুলেই গেছলাম, আমাদের বংশে এখন তো আবার একজন স্পোর্টসউওম্যানও এসে গেছে। ফিফথ জেনারেশন ক্রিকেটার। সতু তোর কী মনে হয়, কালু ইন্ডিয়া রিপ্রেজেন্ট করবে?”
সত্যশেখর উৎসাহে নড়েচড়ে বসল।
”নিশ্চয় করবে। আমি তো ওর দুটো ইনিংস এবার কানপুরে দেখলাম। শান্তা রঙ্গস্বামীও দারুণ প্রেইজ করল। গ্রিট, ডিটারমিনেশন, ক্যারেজ অ্যান্ড টেকনিক, সবই আছে, তবে হাতে আরো দু চারটে মার থাকা দরকার।”
”হবে হবে, আগে ডিফেন্সটা পোক্ত হোক। ভাবছি বাগানের উত্তরে বকুল গাছটার ধারে কালুর জন্য প্র্যাকটিস পিচ করে দেব।”
”দারুণ হবে দাদু।”
কলাবতী প্রায় লাফিয়ে উঠল, দু’ হাত তুলে। রাজশেখর মিটমিট করে তাকিয়ে বললেন, ”আমি এবার তোকে কোচ করব, নেটে আমি বল করব।”
সত্যশেখর হঠাৎ বিষম খেল।
”দাদু, কাকা কিন্তু হাসছে।”
”কেন?”
”মোটেই হাসিনি। মোটরে এসেছি, বেশ ঠাণ্ডা লেগে গেছে, যাই দেখি ট্যাবলেট কিছু যদি…”
সত্যশেখর টেবল থেকে উঠে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
”দুই ছেলের একজনও ক্রিকেটার হল না।” রাজশেখর বিষণ্ণমুখে কলাবতীর দিকে তাকালেন। বড় ছেলে দিব্যশেখর সন্ন্যাসী হয়ে গেছে কলাবতীর মা মারা যাবার পরই। ছোট থেকেই সে ছিল কোমল ও ধীর স্বভাবের, পড়ুয়া ও ঈশ্বরবিশ্বাসী।
রাজশেখর চেষ্টা করেও তার হাতে ক্রিকেট ব্যাট ধরাতে পারেননি। মা—মরা দু’ বছরের কলাবতীকে তার মাসি পুনেতে নিয়ে যান। সে দাদুর কাছে ফিরে আসে দশ বছর বয়সে।
ছোট ছেলে সত্যশেখর সুদর্শন, মার্জিত, সুরসিক ও বুদ্ধিমান তো বটেই, এবং আড্ডাবাজও।
ছাত্র হিসাবে সাধারণ, কিন্তু জাগতিক নানান ব্যাপারে অল্পবিস্তর ধারণা রাখে। পসার বৃদ্ধিতে সম্প্রতি একটি ফিয়াট মোটরগাড়ি কিনেছে (বাবার অনুমতি নিয়ে) স্বোপার্জিত অর্থে। কোর্টে যাতায়াত ছাড়া গাড়িটি পারতপক্ষে সে ব্যবহার করে না। তবে ভাইঝিকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবার জন্য ইদানীং ভোরবেলায় তাকে বেরোতে হয়েছে। কলাবতীর ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার মতো মোটামুটি শিখে গেছে।
সত্যশেখর ব্যারিস্টার হয়ে আসার পর গত পনেরো বছরে রাজশেখর মাত্র তিনবার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে বিয়ে করতে ইচ্ছুক কিনা। ‘এখন ইচ্ছে নেই’, ‘কালু একটু বড় হোক’, এবং তৃতীয়বারে কাঁচা পাকা চুলে আঙুল ডুবিয়ে বলেছিল, ‘তাড়াহুড়োর কী আছে’। বাবাকে সে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে এবং যমের মতো ভয় পায়। তবু ক্রিকেটে সে দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাবেরও উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। ঘুড়ি, লাট্টু, ডাংগুলি বা উড়ন তুবড়িতে তার যে দক্ষতা, তার সিকিভাগও সে ক্রিকেটে অর্জন করতে পারেনি।
”আমার ছেলেরা ক্রিকেট শিখল না। আরে, ক্রিকেট কি শুধু মাঠেই হয়? এটা একটা খেলা, যেমন জীবনটাও একটা খেলা… লাইফ ইজ এ গেম। সোলজাররা বলে, ব্যাটল অব লাইফ—এর কথা, তেমনিই নাবিকরা বলে সাগরের, অভিনেতারা বলে থিয়েটারের কথা, কবিরা জীবনস্বপ্নের গান গায়, আর সাধারণ খেটে—খাওয়া মানুষ একেই বলে জীবনের চলা। আমরা, যারা ব্যাট—বল খেলি, একে গেম অব লাইফ তাহলে বলব না কেন?”
কলাবতী মাথা হেলিয়ে সমর্থন করল।
”চল লাইব্রেরিতে গিয়ে বসি।”
ওরা খাবার টেবল থেকে উঠে লাইব্রেরিতে এসে বসল। দেয়াল—আলমারিতে সার দেওয়া তিন পুরুষের সংগ্রহ। এ—ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ, কলাবতীই শুধু ব্যতিক্রম।
”আমার কী মনে হয় জানিস, জীবনটা যেন সিঙ্গল—উইকেট ম্যাচ, সবার বিরুদ্ধে সবাই, প্রত্যেকেই এখন নয় তো পরে ব্যাট করার সুযোগ পাবে। সব ব্যাপারেই যেমন গুড লাক কি ব্যাড লাক কাজ করে, তেমনি এক্ষেত্রেও আছে, তবে কেউ যদি স্কোর করতে না পারে, সেজন্য দায়ী হবে সে নিজেই।”
কলাবতী মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলল। রাজশেখর সেটা লক্ষ করলেন।
”খেলায় ভাল মন্দ দু—রকম পার্টনারই আছে, যেমন জীবনেও থাকে, সব রকমের বোলিংই খেলতে হয়। কিন্তু ক্রিকেটে যে ট্রেনিং একটা লোক পায়, যেমন—চটপট বিচারবোধ গড়ে তোলার অভ্যাসটা আর সাহসভরে নিশ্চিতভাবে সেটাকে কাজে লাগানো কিংবা ইচ্ছাশক্তিকে জবরদস্ত করা যার ফলে লোপ্পাই বলের কি ফুলটসের টোপের লোভটা সামলে নিতে পারবে, কিংবা হঠাৎ মাথা গরম করে এলোপাথাড়ি ব্যাট যাতে না চালায়—এই যে সব গুণ, এর সঙ্গে সাহস আর ধৈর্য, এ সবই ওই ২২ গজের ঘাসের জমিটা থেকেই তো শেখে, সেটা জীবনের খেলার ক্ষেত্রেও অমূল্য সাহায্য করে।”