”মলয়া কী লিখেছে জান? সতু নাকি বিলেতেও ওকে দুবার জিভ দেখিয়েছিল। তার মানে আজ থেকে পনেরো বছর আগে। কিন্তু তার থেকেও মারাত্মক, আর কী বলেছে জানো? ‘লাঙ্গুলহীন সিংহসন্তানও যে সম্ভব, তা জানা ছিল না। আপনার ছেলেকে চিড়িয়াখানায় পাঠানো উচিত…’ টিপিক্যাল হরিশঙ্করের মেয়ে।”
”দাদু, তুমিই তো গোলমাল বাধিয়েছ। পুনশ্চটা ল্যাজের মতো জুড়তে গেলে কেন? তাহলে তো এই লাঙ্গুল ধরে টানাটানিটা হত না।”
রাজশেখর কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, ”এবার আমি ক্রিকেট ম্যাচে খেলব। মুখুজ্জেদের মুখ আমি পুড়িয়ে ছাড়ব।”
”মুখপোড়া হনুমান!”
”দ্যাটস ইট। হনুমান বানাব। আটঘরায় কালই চিঠি দিয়ে পরমেশ, মতি, নন্তু, ওদের ডেকে আনব। টিম করব।”
”এই বয়সে তুমি খেলবে?”
”কেন খেলব না? গ্রেস, হবস, রোডস, সি কে, দেওধর, ওরা কি পঞ্চাশের পরেও খেলেনি?”
”কিন্তু তোমার যে সত্তর হয়ে গেছে।”
”সে তো পাঁজিপত্তরের হিসেবে, কিন্তু মনের হিসেবে আমি তো পঁচিশের একদিনও বেশি নই, এখনো চল্লিশটা বৈঠক, দশটা ডন দিই, এক মাইল জগ করি। এখনকার কটা ছোকরা পারে? সুতরাং আমি খেলব। বহুদিন আটঘরায় যাওয়া হয়নি। লাস্ট খেলেছি তখন তুমি জন্মাওনি, তিন রানে হেরে গেছলাম।”
রাজশেখর আহত সিংহের মতো অস্থির পায়চারি শুরু করলেন। কলাবতীর তখন মনে হল, দাদুর বয়স সত্যিই পঁচিশ। উত্তেজনায় আর ক্রোধে শরীর থেকে পঞ্চাশটা বছর যেন খসে পড়েছে। লম্বা লম্বা দ্রুত পা ফেলে, শিরদাঁড়া খাড়া রেখে রাজশেখর দেয়াল থেকে দেয়াল পর্যন্ত যাতায়াত করে যাচ্ছেন। দেখে কলাবতীর বেশ অবাক লাগল। এত সামান্য ব্যাপারেই কী রাগ।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে রাজশেখর মুচকি হেসে ফেললেন। ”বুঝলি কালু, তোর বড়দি ইচ্ছে করেই সিংহের ল্যাজ মাড়িয়েছে। আমার ছেলেকে কিনা ল্যাজকাটা সিংহ বলল… অ্যাঁ, চিড়িয়াখানায় পাঠাতে বলল। আশ্চর্য, কী সাহস!”
দাদু ‘তুমি’ থেকে যখন ‘তুই’—এ চলে আসেন, কলাবতী তখন বুঝে যায় গুরুগম্ভীর রাশভারিত্বের জোব্বাটা মেজাজ থেকে খুলে এবার উনি নিজের আসল মজাদার হালকা স্বভাবে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি বন্ধু।
”কিন্তু তোমার পুনশ্চটাই তো গোলমেলে। বাঁদরজাতীয় অনেকেরই তো ল্যাজ নেই—শিম্পাঞ্জি, গোরিলা, ওরাং ওটাং।”
রাজশেখর থমকে দাঁড়ালেন। তাঁকে বিচলিত দেখাচ্ছে। অবশেষে অপ্রতিভের মতো হেসে, মাথা চুলকে তিনি চেয়ারে বসলেন।
”এসব তো ভেবে দেখিনি। তাই তো … টার্জনের শিম্পাঞ্জিটাকে কতবার দেখেছি, ল্যাজ আছে বলে তো মনে পড়ছে না।”
”তাহলে ভুলে যাও সিংহের ল্যাজের কথাটাও। ক্রিকেট ম্যাচ খেলে তোমার দরকার নেই।”
”না, না, একবার যখন মুখ থেকে বেরিয়েছে, সে কথা রাখবই, আমি খেলবই। আর সতু খেলবে, তুইও খেলবি, তিন পুরুষে খেলে এই অ্যানুয়াল ম্যাচের রেকর্ড করব।”
”কিন্তু ওরা যদি আমাকে খেলতে না দেয়? পুরুষদের খেলায় কোনো মেয়ে খেললে প্রোটেস্ট তো করতেই পারে।”
রাজশেখর ধাঁধায় পড়লেন। আমতা—আমতা করে বললেন, ”তা বটে, তা বটে। রেকর্ডটা হলে অবশ্য খুবই ভাল হত। তবে দু’ পুরুষ এই ম্যাচে কখনও খেলেছে কিনা সেটাও খোঁজ নিতে হবে। আমি কালই আটঘরায় চিঠি দিচ্ছি, সতুকেও বলে রাখতে হবে যেন অতি অবশ্য খেলে।”
কলাবতীর কাকা সত্যশেখরের মামলা ছিল কৃষ্ণনগর কোর্টে। ফিরে এসেই অপেক্ষমাণ মক্কেলদের নিয়ে চেম্বারে বসে যায়। রাত দশটায়, এই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী তাকে খাবার টেবলে আসতে হল।
”তোমাকে বিলেতে পাঠিয়েছিলুম বার—অ্যাট—ল হবার জন্য, ভেংচি কাটার জন্য নয়।”
”কিন্তু আমি তো…”
”একটি কথাও নয়।”
রাজশেখরের চাপা ধমকে সত্যশেখর মিইয়ে গেল।
”হরির মেয়েও তখন ওখানে কী যেন পড়তে গেছল। তাকে তুমি জিভ দেখিয়েছিলে। … দু’বার। থাক থাক, চাপা দেবার চেষ্টা কোরো না, সব আমি জেনে গেছি। কিন্তু কেন?”
ইতস্তত করে সত্যশেখর মুখ নিচু করে রুটি ছেঁড়ায় ব্যস্ত কালুর দিকে বার দুই তাকিয়ে বলল, ”সিংহিদের অপমান করেছিল। তোমার পাঠানো বড়ি আর লঙ্কার আচার থেকে ওকে খানিকটা দিতে চেয়েছিলুম, নেয়নি। বলেছিল সিংহিরা আবার বড়ি আচার তৈরি করতে শিখল কবে? এতে কি রাগ হবে না?”
কলাবতী হঠাৎ বিষম খেয়ে মুখটা আরো নামিয়ে ফেলল। দাদু তীব্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।
”কালু, এটা হাসির ব্যাপার নয়… আর দ্বিতীয়বার কীজন্য জিভ দেখিয়েছিলে?”
”কার্ডিফে গ্ল্যামোরগানের সঙ্গে পতৌদির টিম খেলছিল সোফিয়া গার্ডেন্সে। ভীষণ বৃষ্টি। দু’ দলের ফার্স্ট ইনিংসই পুরো খেলা হল না। খুব শীত, মলয়ার সঙ্গে ছিল একটা কাশ্মীরি শাল, আমায় বলল ভাঁজ করে ম্যাকিনটোসের নীচে গলায় জড়াতে।”
”তুমি নিলে?”
”হ্যাঁ।”
”ওফফ!”
”তারপর ল্যাঙ্কাশায়ারের সঙ্গে ইন্ডিয়ানসদের সাউথপোর্টে খেলা।”
”কাকা, ল্যাঙ্কাশায়ারের মাঠ তো ওল্ডট্র্যাফোর্ড, ম্যাঞ্চেস্টারে।”
”হ্যাঁ, কিন্তু বৃষ্টিতে মাঠের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় ম্যাচটা সাউথপোর্টে হয়েছিল। খুব ভাল রোদ উঠেছিল। শালটা ফেরত দেবার জন্য নিয়ে গেছলুম। ও বলল ম্যাচ থেকে ফেরার সময় নেবে। এরপরেই লিডস—এ ফার্স্ট টেস্ট, তাই প্র্যাকটিস নিতে আমাদের ছেলেরা খুব কেয়ারফুলি ব্যাট করে। পতৌদি এক ঘণ্টার উপর ক্রিজে থেকে করে ছয়, সূর্তি তিন ঘণ্টায় চুয়ান্ন। মলয়া এই নিয়ে পাশের এক মেমসাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে খুব বিরক্তি দেখাচ্ছিল। তাইতে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কথা কাটাকাটি হতে হতে আমি শালটা ছুঁড়ে দিই ওর দিকে। বলেছিলুম, ”মুখুজ্জেদের মেয়ে তো, তাই ক্রিকেটের ‘ক’—ও বোঝো না।’ ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল। গটগট করে স্ট্যাণ্ড থেকে নেমে যাবার আগে বলল, ‘যে শালটা ছুঁড়ে দিলে, জানো কি, এইট্টিন এইট্টি ফোরে লখনৌর নবাব ওয়াজিদ আলি যখন মেটিয়াবুরুজে থাকতেন তখন নিজের হাতে ওটা বাবার ঠাকুর্দাকে দিয়েছিলেন? এসব জিনিসের কদর সিংহিবাড়ির লোকেরা কী বুঝবে?’ এই বলে ও একাই মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। মিনিট দশ পর আমি মাঠ থেকে বেরিয়ে ওকে খুঁজছি, তখন একটা বাসের জানলায় ওকে দেখি। বাসটা ম্যাঞ্চেস্টার যাচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই … সেটাই দ্বিতীয়বার।”