”হয়নি, হবে, বোধহয় সামনের রবিবারেই।”
কয়েকজন মেয়ে টিচার এবং ননীবাবু খাবারের বাক্স হাতে শামিয়ানার পিছন দিক থেকে বেরোলেন।
”শুনুন ননীবাবু, শোনো ব্রততী, ইনি কী বলছেন।” হেডমিস্ট্রেস উত্তেজিত কণ্ঠে ওদের ডাকলেন। ”কলাবতী তো ওনাকে দারুণ ইমপ্রেস করেছে, ওর মধ্য দিয়ে নাকি আমাদের স্কুলের শিক্ষা রুচি কালচার ফুটে উঠেছে… সবাই ওকে দুষ্টু বলো, শুধুই ক্রিকেট খেলে একদমই পড়াশুনো করে না বলো, অথচ দ্যাখো উনি কত প্রশংসা করলেন।”
”না না, দুষ্টু তো নয়, অন্নপূর্ণাদি, আমরা কি কখনো তাই বলেছি?”
”সে কী! কলাবতীর মতো বাধ্য মেয়ে আমি তো কুড়ি বছরের টিচারি জীবনে একজনও দেখিনি।”
সভাপতির জন্য প্লেটভরা মিষ্টি আসতেই টিচারদের কলাবতী প্রশস্তি আর এগোল না।
.
তিন পুরুষে খেলে রেকর্ড করব
বাড়িটা ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি। একতলার দেয়ালগুলো তিন হাত চওড়া। ঢালাই লোহার নকশাদার ফটকের একটা পাল্লা বন্ধই থাকে। রাজশেখর সিংহ বছরে তিন—চারবার তাঁর ১৯২৮ সালে কেনা চালবিহীন ফোর্ড গাড়িটা নিজে চালিয়ে যখন বেরোন, শুধু তখনই দুটো পাল্লা খোলার দরকার হয়।
এবারের ভিণ্টেজ কার র্যালিতে চুয়াত্তর বছরের, সওয়া ছ’ ফুট, গৌরবর্ণ, দশাসই রাজশেখর জমিদারবেশে তাঁর ফোর্ড নিয়ে নেমেছিলেন। ডান হাতে স্টিয়ারিং, বাঁ হাতে গড়গড়ার নল। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে নল মুখে দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। কাঁধে গামছা, ধুতি ফতুয়া পরা কলাবতী চাকর সেজে ছিলিমে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল, পিছনের সিটে পাগড়ি মাথায় চাপকান পরা বেয়ারা সেজে কলাবতীর কাকা সত্যশেখর একটা কিংখাবের খয়েরি রঙের ছাতা জমিদারবাবুর মাথার উপর ধরে বসে। বছর পনেরো ব্যারিস্টারি করছে কলকাতা হাইকোর্টে, পসার কিছুটা জমেছে এবং অবিবাহিত।
গাড়িটা যখন মানিকতলা মেইন রোড দিয়ে বাগমারি হয়ে কাঁকুড়গাছির মোড় ঘুরছিল তখন দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে কলাবতী দেখতে পায় ফুটপাথের কিনারে দাঁড়িয়ে বড়দি মলয়া মুখার্জি ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে তাদের গাড়িরই ছবি তুলছেন। সেই সময় তার ৪৫ বছর বয়সী ব্যারিস্টার কাকা বীরদর্পে বিশাল নকল গোঁফটা ডানহাতে চুমরোতে চুমরোতে জিভ বার করে ভেংচি কাটল। কলাবতীর মনে হয়েছিল ভেংচিটা বড়দির উদ্দেশেই, কেননা মোড় ঘোরার সময় গাড়ি যখন ফুটপাথ ঘেঁষে এসেছিল, বড়দি তখন ক্যামেরার শাটার টিপেই বেশ জোরে বলে উঠেছিলেন, ”বাঁদর কোথাকার।”
কথাটা রাজশেখরের কানেও পৌঁছয়।
”মলয়া না? মুখুজ্জেদের মেয়ে কাকে বাঁদর বলল?”
কলাবতী আড়াচোখে পিছনের সিটে তাকিয়ে দেখল, কাকা একমনে সি আই টি রোডের গাছগুলোর মগডাল পর্যবেক্ষণ করছে। সে ঝুঁকে দাদুর কানে কানে বলল, ”কাকাকে।”
”কেন?”
”কাকা বড়দিকে ভেংচি কেটেছে।”
”সতু।”
”আজ্ঞে।” পিছন থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠ ভেসে এল।
”ভেংচি কেটেছ?… জবাব দাও। বুড়ো বয়সেও তোমার এই স্বভাবটা গেল না, চিরকাল তুমি … কোর্টে সওয়াল করার সময় কোনোদিন হয়তো জজকেও ভেংচি কেটে বসবে। … তাছাড়া মলয়া নিশ্চয় ওর বাবাকে এটা জানাবে। উফফ… হরিশঙ্কর মুখ বেঁকিয়ে শেয়ালের মতো হাসছে, এটা তো এখনই আমি দেখতে পাচ্ছি… আমি জানি ও বলবে ‘সিংগিবাড়ির ওরা বরাবরই ছোটলোক, হিংসুটে’। আমি শুনতে পাচ্ছি, হরিশঙ্কর এই কথাই বলছে আর … উফফ…।”
”দাদু সামনে… সামনের রাস্তায় চলো।”
রাজশেখর উল্টোডাঙার মোড়ে এসে স্টেশনের দিকে গাড়িটা চালিয়ে ফেলেছিলেন। ডানদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নজরুল ইসলাম সরণি ধরলেন এয়ারপোর্টের উদ্দেশে, যেখানে পৌঁছে র্যালি আবার ফিরে আসবে রাজভবনের সামনে।
রাজশেখরের ফোর্ড এই র্যালিতে চতুর্থ হয়েছিল।
কিন্তু সেইদিন রাতেই রাজশেখর দোতলার লাইব্রেরিতে বসে একটা চিঠি লিখে কলাবতীকে ডাকেন।
”এটা কাল তোমার হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখুজ্জেকে দেবে, স্কুল বসার আগেই। ভুলো না যেন।”
চিঠি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ”দাদু, শেয়ালের হাসি তুমি দেখেছ? কেমন দেখতে?”
”হরিশঙ্কর একটা শেয়াল। সে হাসলেই সেটা শেয়ালের হাসি। সেই ছোটবেলা থেকে ওকে জানি, এক স্কুলে পড়েছি, ক্রিকেটও খেলেছি ওর সঙ্গে। আমি টাউনে, ও এরিয়ানে। দারুণ ধূর্ত।”
নিজের ঘরে এসে কলাবতী চিঠিটা পড়েছিল। তাতে লেখা : ‘কল্যাণীয়া মলয়া, গতকাল আমার পুত্র তোমাকে জিহ্বা প্রদর্শন করায় আমি যৎপরোনাস্তি লজ্জিত ও সন্তপ্ত। সিংহসন্তানের পক্ষে এহেন মর্কটোচিত আচরণ অকল্পনীয়, জানি না কোথা হইতে সে এই কু—অভ্যাস অর্জন করিয়াছে। বিলাত গিয়া সে কীরূপ মানুষের সহিত মেলামেশা করিয়াছিল জানি না। আমি তাহার এবং আমার পূর্বপুরুষদের পক্ষ হইতে তোমার নিকট মার্জনা চাহিয়া লইতেছি। আশা করি তুমি আমার পুত্রের অভব্যতা ভুলিয়া যাইবে। আশীর্বাদক, ভবদীয়, রাজশেখর সিংহ।” পুনশ্চ—’বাঁদর অতিশয় বজ্জাত প্রাণী এবং ইহার একটি লাঙ্গুল আছে, আমার পুত্রের লাঙ্গুল নাই।’—রা সি
পরদিন প্রথম পিরিয়ডের আগেই কলাবতী দাদুর চিঠিটি বড়দির বেয়ারা মিশিরের হাতে দিল। শেষ পিরিয়ডে মিশির একটি খাম ক্লাসে এসে কলাবতীকে দিয়ে যায়। খামের উপরে লেখা : ‘পূজনীয় শ্রীরাজশেখর সিংহ!’ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই সে খামটা দাদুর টেবলে রেখে দেয়। সন্ধ্যায় দাদু তাকে ডেকে পাঠান।