মেয়েদের বিশেষ করে গার্জেনদের মধ্যে এবার কলরব শুরু হল। কেউ কেউ দু—চার পা এগিয়ে এলেন। মস্তানকে এবার নার্ভাস দেখাল। ফলা মুড়ে সে ছোরাটা পকেটে রাখল। এধার ওধার তাকাচ্ছে বোধহয় পালাবার পথ খুঁজতে।
”বড়দি আমরা কি গুণ্ডাটাকে এবার ধরব?” একটি মেয়ে চেঁচিয়ে জানতে চাইল।
”না, না, ধরতে যেও না, সঙ্গে ছোরা আছে, পুলিশ এসে ধরবে।”
গো অ্যাজ ইউ লাইক—এর প্রতিযোগীরা একধারে দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে রয়েছে ঝাড়ুদারনি, ভিখারী, বৈষ্ণবী, চানাচুরওলা, পাগলি, ডাকপিয়ন, বাসানউলি আর ত্রিশূল হাতে ভৈরবী। ওরা যে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সব চোখ আর মন কেড়ে রেখেছে মস্তান।
এই সময় ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ ‘আঁ আঁ আঁ’ শব্দ শোনা গেল এবং সেই সঙ্গে মাটিতে একটি মেয়ে পড়ে গেল মূর্ছিতা হয়ে।
”ফেণ্ট ফেণ্ট, সুস্মিতা ফেণ্ট হয়েছে।”
”জল, জল আন… বাতাস কর। ভয়ে বোধহয় অজ্ঞান হয়েছে।”
গুণ্ডা থেকে সবার মনোযোগ চলে গেল সুস্মিতা নামের মেয়েটির দিকে। হুড়োহুড়ি, চেঁচামেচি শুরু হল। দিদিমণিরা ছুটে গেলেন, সেই সঙ্গে হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জিও। সভাপতি কিন্তু চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার মুচকি হাসতে হাসতে লক্ষ করলেন, মস্তানটি তীরবেগে পার্কের গেটের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে।
”গুণ্ডা পালাচ্ছে, বড়দি, গুণ্ডা পালাচ্ছে।”
সব চোখ যখন গেটের দিকে তাকাল, তখন লাল জামাটা গেটের বাইরে ডানদিকে ঘুরে অদৃশ্য হচ্ছিল।
মিনিট দুই পরে জলের ঝাপটা আর খাতার হাওয়া খাওয়ার পর সুস্মিতা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
তারপর এক গাল হেসে বলল, ”কেমন করলুম বল তো, নইলে কালুটা পালাতে পারত না।”
”যাক গুণ্ডাটা নিজেই তাহলে পালিয়ে গেল।” বড়দি আবার তাঁর প্রশান্তি ফিরে পেয়ে সভাপতিকে খবরটা দিলেন।
‘হ্যাঁ, ভালই হল। ফার্স্ট প্রাইজটা ওই পাবে।”
”কিসের ফার্স্ট প্রাইজ!”
”গো অ্যাজ ইউ লাইকের।”
হেডমিস্ট্রেস এমন ভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন তাঁর স্কুলের পঁচাত্তর জন মেয়েরই ফার্স্ট ডিভিশনে উচ্চচ মাধ্যমিক পাশ করার খবর শুনলেন।
”গুণ্ডা কোথায়, ও তো মেয়ে!” সভাপতির বিস্ময় চোখমুখে ফুটে উঠল। ”আপনার স্কুলেরই নিশ্চয়, দারুণ করল কিন্তু।”
বলতে বলতে সভাপতি দেখতে পেলেন পার্কের গেট দিয়ে ঢুকছে সবুজ খয়েরি নকশার চুড়িদার ও কামিজ পরা এক শ্যামলা মেয়ে। ছিপছিপে বেতের মতো শরীর, মাথার চুল ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা, মিষ্টি মুখের গড়নটি পানের মতন। কয়েকটি মেয়ে ওকে দেখামাত্র ছুটে গেল। ও হাসতেই দুটি চোখ এবং দাঁতের সারি ঝকঝক করে উঠল। ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ায় সভাপতি আর মেয়েটিকে দেখতে পেলেন না।
”আমার স্কুলে এমন মেয়ে?” হেডমিস্ট্রেস কাঁদো কাঁদো হয়ে সামনে মেয়েদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই সময় অসীমা দত্ত এসে বড়দির কানে কানে কিছু বলতেই তিনি, ”এত বছর ধরে ক্লাসে পড়াচ্ছ অথচ তোমরা কেউ চিনতেই পারলে না!” বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
পুরস্কার প্রদান শুরু হল। একে একে প্রাপকরা নেবার পর সবশেষে ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’—এর প্রথম পুরস্কার নেবার জন্য নাম বলতে গিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে অসীমা দত্ত দুবার গলা খাঁকারি দিলেন এবং দুবার ঢোঁক গিলে বললেন, ”প্রথম হয়েছে, ইলেভেন বি—র কলাবতী সিংহ। ও সেজেছিল গুণ্ডা।”
তুমুল হাততালি আর চিৎকারের মধ্যে কলাবতী হাসিমুখে তার পুরস্কার নিল সভাপতির কাছ থেকে। তারপর সে অসীমা দত্তর কাছে গিয়ে বলল, ”দিদি মাইকটা দিন, আমি একটা কথা বলব।”
তিনি একবার বড়দির দিকে তাকিয়ে কী ভেবে সরে দাঁড়ালেন।
”মাননীয়া বড়দি এবং অন্যান্যরা,” কলাবতী সহজভঙ্গিতে কোনো কুণ্ঠা প্রকাশ না করে বলল, ”আজ আমার আচরণে, কথাবার্তায় যদি আপনারা আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আমার সবটাই অভিনয়। একজন কম্পিটিটর হিসাবেই সব করেছি, এই কথা মনে রেখে আপনারা স্পোর্টিংলি আমাকে বিচার করবেন। গুরুজনরা সবাই আমার শ্রদ্ধাপ্রণাম নেবেন।”
সভাপতি মাথা দুলিয়ে মলয়া মুখার্জিকে বললেন,”আপনার স্কুলের শিক্ষা, রুচি, কালচার এই মেয়েটির মধ্যে ফুটে উঠেছে। অন্যসব স্কুলে যা দেখি সে আর কহতব্য নয়, টিচারদের সম্পর্কে কোনো শ্রদ্ধা নেই, ভালবাসা নেই, ডিসিপ্লিন নেই।”
শুনতে শুনতে হেডমিস্ট্রেস আনন্দে, গর্বে বরফের মতো একবার গললেন, আবার বাষ্পের মতো ভেসে বেড়াতে লাগলেন।
”কলাবতীর ঠাকুর্দা আটঘরার জমিদার, এখন অবশ্য জমিদারি নেই, কিন্তু বনেদী পরিবারের শিক্ষাটা তো আছে। আমাদের বকদিঘির পাশেই আটঘরা গ্রাম। ওদের সবই জানি, ওরাও আমাদের সব জানে। ওরা যেমন কালচার্ড তেমনি… ” মলয়া মুখার্জি থেমে গেলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ”তেমনি জেদি।”
”আচ্ছা আচ্ছা! গ্রামের নামদুটো শোনা শোনা মনে হচ্ছে যেন, ওদের মধ্যে কি বছরে একবার একটা ক্রিকেট ম্যাচ হয়? কয়েক বছর আগে কাগজে খবর দেখেছিলাম মনে হচ্ছে।”
সভাপতির দিকে তাকিয়ে মলয়া মুখার্জি হাসতে শুরু করলেন। ”এই এক অদ্ভুত রেষারেষি দুই জমিদারবাড়ির মধ্যে। একেবারে ছেলেমানুষি কাণ্ড। বুড়ো বুড়ো লোকেরা যে কী রকম অবুঝ বাচ্চচা হয়ে যায় তখন, না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।”
”বটে, তাই নাকি, তাহলে তো দেখতে হয়। এবারের ম্যাচটা কি হয়ে গেছে?”