”ল্যাং তো খাবেনই মাস্টারমোসাই, আপনিও কি পরীক্ষার খাতায় ল্যাং মারেন না?”
কোমর দুলিয়ে মস্তান এগিয়ে এল বসন্তবাবুর সামনে। বসন্তবাবু তিনপা পিছিয়ে ব্রততী বেদজ্ঞ নামক সুপুরিগাছের পাশে চলে এলেন।
”কিন্তু আপনি কেন ল্যাং মারলেন দিদি?”
মস্তান ডান হাতের তর্জনী তুলে ব্রততী বেদজ্ঞকে প্রশ্নটা করল। ব্রততী বটের গুঁড়ির অর্থাৎ অন্নপূর্ণা পাইনের পিছনে সরে গিয়ে বললেন, ”আ… আ… আমি আবার কখন ল্যাং মারলুম, অ্যাঁ… অন্নপূর্ণাদি, তুমি কি দেখেছ? আমি তো…”
”আলবাত, লেঙ্গি মেরেচেন।” মস্তান তার ঊরুতে ফটাশ করে চাপড় মেরে একটু কুঁজো হয়ে স্বরটা খসখসে ভীতিপ্রদ করে বলল, ”এখানে হচ্ছে স্পোটস আর আপনারা হচ্ছেন স্পোটসম্যান, স্পোটিং ইস্পিরিট নিয়ে আপনারা তো লড়বেন, ঠিক কিনা?”
স্তব্ধ ফ্যালফ্যালে মেয়েদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে মস্তান দুবার মাথা নাড়তেই কয়েকটি মাথা দ্রুত হেলে গেল।
”আপনারাই যদি আনস্পোটিং কাজ্যকলাপ করেন তাহলে মেয়েরা কী সিকবে আপনাদের দেকে? আমি পাঁচিলের ওধারে তকন থেকে দাঁড়িয়ে সব দেকচিলুম, অনেক কথা কানে আসচিল। আপনারা প্রাইজের লোভে স্পোট করতে নেমেছেন, তাই না?”
”না না, কে বলল আমরা প্রাইজের লোভে…” অন্নপূর্ণা পাইনের বেদনাহত স্বর আর কথা খুঁজে পেল না।
”ননীবাবু, আপনিই বলুন আমরা কি…” আর এক মেয়েটিচার বললেন।
”আমরা প্রাইজ নেবই না।”
”অন্যায়ভাবে নেব কেন, আমরা সবাই স্পোর্টসম্যান।”
”দিদি, স্পোর্টসউওম্যান হবে।” ভিড়ের মধ্য থেকে কে বলল।
মস্তানের এবার হাসার কথা। সুতরাং কোমরে হাত দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ‘শোলে’—র গব্বর সিংয়ের মতো ‘হা হা’, হো হো’ করে বিকটস্বরে, দেহ কাঁপিয়ে সে হাসতে শুরু করল।
”প্রাইজ নেবে না… হা হা হা…, দিদিমণিরা বলচেন… হো হো হো… মাইকে অ্যালাউন্স করে দিন…।”
মস্তানের দাঁতগুলি সাজানো ঝকঝকে। তবে উপরের পাটিতে ডান কষের একটা দাঁত যে নেই, সেটা এবার দেখা গেল।
‘অ্যাই, অ্যাই,” ভিড়ের মধ্যে একটি মেয়ে পাশের জনের কানে ফিসফিস করে বলল, ”আমাদের কালু রে।”
”যাহ।”
”আমি বলছি। দাঁতটা ওর অনেকদিন ধরেই নড়ছিল, পরশু ছুটির পর আমরা একসঙ্গে যখন বাড়ি ফিরছিলুম, তখন এক হ্যাঁচকা টানে ও দাঁতটা উপড়ে ফেলল।”
”কী মেয়ে রে বাবা। কী দারুণ মেকআপ নিয়েছে। কোথা থেকে এভাবে সাজল বল তো? আমাদের কিচ্ছুটি বলেনি।”
”একেবারে ছেলের মতো দেখাচ্ছে।”
”একদম। কী সাহস বাব্বা, বসন্তকে শীত বানিয়ে দিয়েছে।”
”পাইন ফরেস্টও সাফ।”
”যখন জানতে পারবে, কী হবে।”
”এখন কাউকে বলিসনি, চেপে থাক।”
ওদিকে হেডমিস্ট্রেস হাত নেড়ে স্কুলের দরোয়ান মিশিরকে কাছে ডেকে ভয়ার্তস্বরে বললেন, ”করছ কী তুমি, তাড়িয়ে দাও গুণ্ডাটাকে। মেয়েদের সঙ্গে যদি অসভ্যতা করে তাহলে গার্জেনরা কী বলবেন আমাদের? যাও, বার করে দাও।” মিশির তার ভুঁড়িতে হাত রেখে করুণস্বরে বলল, ”বড়দিদি, এখানকার গুণ্ডারা বড় খারাপ আছে। এদের সঙ্গে চাকু, ক্ষুর, ছোটখাটো বন্দুকও থাকে।”
”তাহলে দৌড়ে পুলিশ ডেকে আনো।”
হেডমিস্ট্রেসের চেয়ারের হাত চারেক দূরে মাইক্রোফোনটা তখন সচল ছিল। লাউড স্পিকার থেকে আবছাস্বরে ওদের কথাগুলো সবাই শুনতে পেল।
”অ্যাই, দারোয়ান।” মস্তান চিৎকার করে দৌড়ে গেল শামিয়ানার দিকে। ”পুলিশ বোলানেকে লিয়ে যানেকা আগেই তুমহারা ভুঁড়িমে…” মস্তান হিপ পকেট থেকে ছুরি বার করে স্প্রিং টিপতেই ছয় ইঞ্চি ফলা ছিটকে বেরোল। কবজি নাড়িয়ে ফলাটা এপাশ—ওপাশ করে ঝিলিক দিতে দিতে কুঁজো হয়ে সে গুটিগুটি মিশিরের দিকে এগোতেই সে ”হায় রামজি, মর গিয়া” বলেই বড়দিদির চেয়ারের পিছনে আশ্রয় নিল।
সভাপতি প্রথমদিকে ভ্রূ কুঁচকে দেখছিলেন। এই রকম স্পোর্টসে বহুবার ‘সভাপতি’ বা ‘প্রধান অতিথি’ হয়ে এখন ঝানু। ব্যাপার বুঝতে তাঁর বিশেষ দেরি হয়নি। মুচকি হেসে পাশের ফ্যাকাসে মুখ হেডমিস্ট্রেসকে বললেন, ”দারুণ করছে, কী বলেন?”
কথাটা বড়দিদির কানে গেল না। তিনি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ”চলে যাও, যাও এখান থেকে। মেয়েদের স্পোর্টসে এসব অসভ্যতা বাঁদরামি চলবে না। আমি পুলিশ ডাকব, অ্যারেস্ট করাব তোমায়।”
”আমাকে বাঁদর বললেন?”
”নিশ্চয় বাঁদর।”
”তাহলে আমার ন্যাজ কই?”
হেডমিস্ট্রেসের কানে মেয়েদের হাসির রোল পৌঁছতেই তিনি আরো রেগে উঠলেন। মিশির এই সময় পিছু হটতে হটতে হাত দশেক দূরে গিয়েই দৌড়বার জন্য সবে ঘুরেছে, আর তখনই মস্তান চেঁচিয়ে উঠল, ”অ্যাই মিশির, খাড়া রহো। এক কদম বাড়েগা তো এই চাক্কু ভুঁড়িমে…।” ছুরিটা বাতাসে বিঁধিয়ে ডান—বাম আড়াআড়ি চালিয়ে মস্তান বুঝিয়ে দিল পরের ঘটনা কী ঘটবে।
”দিদিমণিরা তো প্রাইজ নেবে না, তাহলে কী হবে?”
”যাই হোক, তুমি এখান থেকে দূর হও।”
”তাহলে আমিই নোব।”
মস্তান টেবল থেকে ব্যাগ তিনটি তুলে নিয়ে চোখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ”বাঃ, বাঃ, নিজেদের জন্য সুন্দর সুন্দর ব্যাগ আর মেয়েদের জন্য প্লাস্টিকের চিপ জিনিস, বাঃ, খুব ভাল।”
আর একবার মেয়েদের হাসির হলকা হেডমিস্ট্রেসকে ঝলসে মুখটা লাল করে দিল। তিনি প্রায় ঝাঁপিয়েই মাইক্রোফোনটা ধরে মুখের কাছে এনে চিৎকার শুরু করলেন, ”পুলিশ পুলিশ… হেল্প হেল্প, গুণ্ডা এসে মেয়েদের আক্রমণ করেছে, বাঁচান, আমাদের বাঁচান…।”