ছোঁ মেরে সুশি চাবিটা সরার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ”ফাইনালটা খেলে দেওয়ার পর টোকেন। আপনারা বৈঠকখানা ঘরে বসুন, টাকা আনছি।” বলেই সুশি ছুটল দোতলায়।
তিনজনেই যথেষ্ট অবাক। যে টাকা ডাকাতি হয়েছে বলে তারা শুনেছে সেই টাকা আনতে গেল কিনা এই মেয়েটি!
সত্যশেখর বলল, ”ব্যাপার কী রে কালু?”
কলাবতী জবাব দেওয়ার আগেই সরা বলল, ”ব্যাপার কিছুই নয়, ডাকাতরা ভূতের তাড়া খেয়ে অ্যাটাচি কেসটা মাঠে ফেলে পালিয়ে যায়, কলাবতী সেটা কুড়িয়ে পেয়েছে।”
”বাবা বলছিল এখানে ভূত আছে বলে লোকে বিশ্বাস করে। তা হলে সত্যি—সত্যিই আছে। তোকে তাড়া করেনি তো কালু?”
মুখটাকে গম্ভীর করে কলাবতী বলল, ”করবে কী করে, বড়দি পইপই করে বলে দিয়েছিল বেলগাছ, শ্যাওড়াগাছের দিকে না যেতে। আমি একদম যাইনি। বলে দিয়েছিল ভূতেদের পা খুব লম্বা হয়, তাড়া করলে শাড়ি পরে ছুটতে পারবে না। আমি শাড়ি পরিনি।”
সুশি অ্যাটাচি কেস নিয়ে এল। চাবি দিয়ে ঢাকনাটা খুলতেই দেখা গেল বাণ্ডিল করা হাজার টাকার নোট থরে—থরে বিছানো। বিশুবাবু তার অ্যাটাচি থেকে কোর্টের স্ট্যাম্প পেপার বার করে সরার হাতে তুলে দিল। তার মুখে জ্বলজ্বল করে উঠল মুক্তি পাওয়ার আনন্দ। কৃতজ্ঞ চোখে সে কলাবতী, সুশির দিকে তাকাল।
”তা হলে বাবা কাল বংশীবদন বি এস সি—র ঘরে উঠছে!”
সবাই ফিরে তাকাল দরজার দিকে। ব্যাংকাকা দাঁড়িয়ে।
”জান লড়িয়ে খেলব,” সবার গলায় প্রতিজ্ঞার সুর। ”প্রত্যেক বছর আমি খেলে দিয়ে যাব, যদি কলেজটা হয়।”
”তা হলে এবার যাওয়া যাক।” বিশুবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”পতিতদা আমাদের ‘নো অবজেকশন’ চিঠিটা কলকাতায় গিয়েই দোব।”
”এ কী, এখুনি যাচ্ছেন কী, একটু মিষ্টিমুখ না করলে হয়!” ব্যাংকাকা আপত্তি তুললেন। ”ইকড়ির সুবল সামন্তর মাখা সন্দেশ এই অঞ্চলের বিখ্যাত মিষ্টি। আনতে লোক পাঠিয়েছি।”
”বটে, বটে।” সত্যশেখর চেয়ারে বসে পড়ল। ”আগে তো কখনও শুনিনি অথচ আমি কিনা হুগলিরই সন্তান।” তাকে মর্মাহত দেখাল।
মিষ্টিমুখ সেরে, ফেরার জন্য গাড়িতে বসে পতিত ভটচায বলল, ”হ্যাঁ রে সরা, তুই ন্যাড়া হলি কেন?”
কলাবতী বলল, ”কলকাতার রোনাল্ডো হবে বলে।”
বিশুবাবু চিন্তিত স্বরে বলল, ”বদুটা যে গেল কোথায়!”
সত্যশেখর বলল, ”দু’ কিলো মাখা নিয়ে যাস রে কালু।”
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় শেতলের মা পড়িমরি দোতলায় ছুটে উঠে এল। ভয়ে তার চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে। ”ও দিদিমণিরা, কেমন যেন আওয়াজ হচ্ছে শিবমন্দিরে ওদিক থেকে। তোমরা যে বললে ভূতটুত সব মিচে কতা? কই আগুতে তো এখন আওয়াজ হতনি?”
সুশি বলল, ”হতনি তার কারণ তখন ভূতেদের খিদে পেতনি। কালু এবার চল দুটো দানাপানি খাইয়ে আসি ভূতটাকে।”
”কদ্দিন ওকে আটকে রাখবি?”
বংশীবদন ঘরে উঠলে ওকে ছাড়ব।”
.
বংশীবদন শিল্ড প্রথমবার জিতল বোলতা স্পোর্টিং ক্লাব। স্বনামেই খেলেছে স্বরাজ দাস। দর্শক সমাগমে কেউ কেউ দাবি করেছে এটা মহকুমার রেকর্ড। এম এল এ এবং রাজ্যের এক প্রতিমন্ত্রীর হাত দিয়ে পুরস্কার দেওয়া হয়। ভূদেব খেটো ঘোষণা করেন, গড়ের মাঠে কলেজ স্থাপন করা হবে। ম্যাচে সরা ডাবল হ্যাটট্রিক করতে পারেনি। কিন্তু বোলতার লোকেরা তাতে অখুশি নয়। তারা দেখল ম্যাচ শেষ হওয়ার সাত মিনিট আগে পর্যন্ত বি এস সি দু’ গোলে হারছিল, তারপর স্বরাজ দাস অলৌকিক খেলা খেলে তিনটি গোল দিল। এমন রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় তারা আগে কখনও পড়েনি বা এমন শিহরন তারা আগে কখন অনুভব করেনি। তারা পটকা ফাটাল, হাউই ওড়াল, আবির মাখল। বোলতা হাই স্কুলের হেডমাস্টার ঘোষণা করলেন, কাল স্কুলের ছুটি থাকবে।
ভি আই পি এনক্লোজারে বসা সুখি দাস গজগজ করে বলে, ”দুটো কেন, তিনটে ক্লাব থেকে সরা অ্যাডভান্স নেওয়ার মতো খেলেছে।”
সুশি কলাবতীর কানে—কানে বলল, ”সরাকে যেন ভূতে পেয়েছিল। সত্যিই দারুণ খেলল।”
ঘণ্টুকে ডেকে কলাবতী তার হাতে টোকেনটা দিয়ে বলল, ”এটা সরাকে দিয়ে এসো। ম্যান অব দ্য মাচের প্রাইজ।”
বাড়ি ফিরে কলাবতী আর সুশি পাতালঘরের গর্তের কাছে গেল। মইটা গর্ত দিয়ে নামিয়ে সুশি বলল, ”এবার উঠুন আর ভয় নেই। সারা বোলতা এখন নাচানাচি করছে, কেউ আর আপনার দিকে তাকাবে না।”
উঠে এল বদু ধুঁকতে—ধুঁকতে। ”আমি এখন সেফলি যেতে পারব তো?”
কলাবতী বলল, ”পারবেন, তবে ওই কালো জামাটা খুলে।”
আরও সাতদিন বোলতায় থেকে ওরা কলাকাতায় ফিরে আসে। আসার দিন সকালে ব্যাংকাকা একটা প্যাকেট কলাবতীর হাতে দিলেন। কলাবতী সেটা খুলে দেখল দুটো শাড়ি। এই দুটোই সুশি বেছেছিল বোলতা বস্ত্রালয়ে। শাড়িতে পিন দিয়ে কাগজ আঁটা। তাতে লেখা : ”বোলতার জনগণের কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা তোমরা গ্রহণ করো। আবার এসো। ইতি, ভূদেব খেটো।”