সত্যশেখররা সরাদের বাড়ির মধ্যে তখন। তাদের দেখে তো সরার মা সুখির মুখ গম্ভীর।
শ্যামপুকুর ক্লাবের বিশুবাবু দু’হাত জোড় করে বলল, ”চিনতে পারছেন। আমিই এসে অ্যাডভান্সের টাকা দিয়ে গেছলুম। পতিতবাবু কাল বললেন সরা ওটা ফেরত দিতে চায়। তাই ফেরত নিতে এসেছি। কোর্টের স্ট্যাম্প পেপারটাও ফেরত দোব বলে এনেছি। সরা কোথায়?”
সরার দিদি অমিতা বলল, ”সরা বাজারে গেছে। বাবা গেছে শ্যাওড়াফুলিতে, কাজে।”
পতিত ভটচায বলল, ”দুটো ক্লাব থেকে টাকা নিয়ে সরা খুবই অপরাধ করেছে। এজন্য ও শাস্তি পেতে পারে। যাই হোক, শ্যামপুকুরের ব্রজবাবু অদ্দুর আর যেতে চান না। আমাদের অনুরোধে সরাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছেন। বিশুবাবু এসেছেন টাকা ফেরত নিতে। ওকে দিয়ে দিন।”
সুখি দাসের থমথমে মুখে এবার কান্না ভেঙে পড়ল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ”সে টাকা কি আর আছে, সে তো পরশুদিন ডাকাতে এসে নিয়ে গেছে।”
সত্যশেখর অবাক স্বরে এবার বলল, ”তা কী করে হয়! আমার ভাইঝি কালু এখান থেকে টেলিফোন করে পরশুই বলল টাকাটা রেডি করা আছে। কখন ডাকাতি হয়েছে?”
অমিতা বলল, ”বিকেলে, যখন ফুটবল খেলা চলছিল।”
সত্যশেখর বলল, ”আর কালু তো আমায় ফোনে বলল সন্ধে বেলায়!”
বিশু বলল, ”এখানে একটা বাড়িতে গেছলুম সেখানে ছিপছিপে লম্বা কালো রঙের একটি মেয়েকে দেখেছি নাম কলাবতী, সেই কি?”
”হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ভাইঝি।”
”চলুন তো, মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি।”
বিশুবাবু কথাটা সবে শেষ করেছে তখনই পাড়া কাঁপিয়ে ”ডাকাত, ডাকাত” রব উঠল।
এদিকে বদু ছুটতে—ছুটতে সুশিদের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। কলাবতী তখন ঘন্টুদের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধানভানা দেখতে যাওয়ার জন্য দোতলা থেকে নামছে। ঢেঁকি সে কখনও দ্যাখেনি। দাদুর কাছে শুনেছে দেশ থেকে নাকি ঢেঁকি তাড়িয়ে দিয়েছে রাইস মিল। হঠাৎই বদুকে ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে সে পথ আটকে বলল, ”এ কী! কোথায় যাচ্ছেন? আজও কি বাড়ি সার্চ করবেন নাকি?”
”আমাকে ডাকাত বলে তাড়া করেছে সরার পাড়ার মেয়েরা। হাতে বঁটি, কাটারি, আরও কত কী, মেরেই ফেলে দেবে। সরার বাড়িতে আমরা গেছলুম টাকাটা ফেরত নিতে।”
”আমরা কারা?”
”ব্রাদার্সের পতিতদা, শ্যামপুকুরের বিশুদা আর সত্য বলে একটা লোক।”
”ওহহো, কাকাকে তো বলাই হয়নি টাকাটা কোথায়!”
”থানায় খবর দিতে গেছে। আমাকে কিছুক্ষণ ঘাপটি দিয়ে থাকতে হবে। এখনও তিনটে পুলিশ কেস ঝুলছে। কী বিপদে যে পড়লুম ক্লাবের জন্য সার্ভিস দিতে এসে।”
”লুকিয়ে থাকতে চান? আচ্ছা আসুন, লুকোবার খুব ভাল জায়গা আছে।”
দ্রুত পায়ে কলাবতী নীচে নেমে এল। পেছনে বদু। খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে দিঘির ধার দিয়ে শিবমন্দিরের পেছনে হাজির হল। পাতালঘরের গর্তে মইটা লাগানোই রয়ে গেছে। সে আঙুল দেখিয়ে বলল, ”শিগগিরি নেমে পড়ুন। থানার বড়বাবুর ডাকাত ধরার খুব শখ, এক্ষুনি এসে পড়বেন।”
বদু ইতস্তত করে বলল, ”এই গর্তটা কীসের?”
”পাতালঘরের, ডাকাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। নেমে পড়ুন, নেমে পড়ুন।” কলাবতী তার পিঠে ধাক্কা দিল। দূরে বাবার সড়ক দিয়ে কয়েকটি লোক উত্তেজিত ভাবে লাঠি হাতে যাচ্ছে। বদু আর একটিও কথা না বলে মই বেয়ে নীচে নেমে গেল। সে নামামাত্রই কলাবতী মইটা টেনে তুলে নিল।
”এ কী, এ কী! পাতালে নামিয়ে মই কেড়ে নিলে কেন? আমি উঠব কী করে?” বদুর আর্তস্বর গর্ত থেকে উঠে এল।
”মই না থাকলে পুলিশও নামতে পারবে না। এটাই কি ভাল হল না?”
”তোমার খুব বুদ্ধি আছে। পরে মই লাগিয়ে দেবে তো?”
”নিশ্চয় দোব।” কলাবতী মইটা গর্তের পাশে রেখে ফিরে এল। তাকে দেখে সুশি বলল, ”কোথায় গেছলি? চল ঘন্টুদের বাড়ি।”
”পরে যাব। এদিকে একটা খুব মজা হয়েছে।” কলাবতী তারপর যা ঘটেছে সুশিকে বলল।
সুশি শুনে বলল, ”বাছাধন এখন ভূতেদের দানা খাওয়াক।”
কলাবতী সবে সদরে পৌঁছেছে। তখন সদলবলে বড়বাবু বাড়িতে ঢুকলেন। সঙ্গে সরা, সত্যশেখররা এবং প্রায় সারা বোলতাবাসী।
”এখানে ডাকাত ঢুকেছে?” সুশিকে সামনে পেয়ে বড়বাবুর প্রথম প্রশ্ন।
সুশি আকাশ থেকে পড়ল। ”ডাকাত! কই, না তো!”
”তুমি কতক্ষণ এখানে আছ?”
ছেলেমানুষি গলায় সুশি বলল, ”সকাল থেকেই। কাউকে তো বাড়িতে ঢুকতে দেখিনি। আপনি শুধু আমাদের বাড়িতেই ডাকাত ঢুকতে দেখেন।”
মেজোবাবুর দিকে তাকিয়ে বড়বাবু বললেন, ”তা হলে কোথায় গেল ডাকাত?”
”পাশের বাড়ি, তার পাশের বাড়ি সার্চ করে দেখব সার?”
”চলুন।”
ওরা বেরিয়ে যেতেই কলাবতী জড়িয়ে ধরল সত্যশেখরকে। ”কাকা, যা সব কাণ্ড এখানে হচ্ছে।”
”খুব বেঁচে গেছি রে কালু। এ কোথায় এসে পড়লুম! মেয়েরা ঘিরে ধরে পেটাতে শুরু করে দিল। ভাগ্যিস এই স্বরাজ দাস এসে পড়ে আমাদের বাঁচাল।”
বিশুবাবু বলল, ”হতভাগা বদুটাই যত নষ্টের গোড়া। কেন যে সঙ্গে করে আনলুম। এত টাকা নিয়ে মোটরে যাব, পথে যদি কিছু ঘটে তাই ভাবলুম সঙ্গে একটা গার্ড থাকা ভাল।”
সত্যশেখর বলল, ”কিন্তু গার্ডটি গেল কোথায়?”
পতিত ভটচায বলল, ”গার্ড চুলোয় যাক, টাকাটা যে ডাকাতি হয়ে গেছে।”
কলাবতী আর সুশি মুখ টিপে হাসছিল। সরা তাই দেখে পকেট থেকে একটা চাবি বার করে দেখিয়ে বলল, ”আমার টোকেনটা এবার দেবে তো?”