”তুমি এবার ডাঙায় ওঠো।” সরা হাত নেড়ে ডাকল। ”আমি এখনই থানায় যাচ্ছি। গিয়ে বলব অ্যাটাচি কেসটা তুমি গড়ের মাঠ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছ। ডাকাতি নিয়ে আর আমাদের কোনও অভিযোগ নেই।”
কলাবতী দাঁড় বেয়ে নৌকাটাকে ঘাটে নিয়ে এল। অ্যাটাচি কেস হাতে পাড়ে নেমে সরাকে সে বলল, ”চাবিটা আছে নাকি তোমার কাছে? তা হলে খুলে দেখতুম। একসঙ্গে সাড়ে তিন লাখ টাকা কখনও দেখিনি তো!”
”ঠাট্টা পরে করবে। সত্যিকারের ডাকাত কিন্তু এসে পড়তে পারে। এটা নিয়ে ওপরে চলে যাও। আমি থানায় যাচ্ছি।”
ওরা দু’জন দোতলায় উঠে যাওয়ার পর সরা বেরোতে যাচ্ছে, তখনই বড়বাবু, মেজোবাবু আর কনস্টেবল বলাই বাড়িতে ঢুকল। তাদের পেছনে একটা ভিড়, নেতৃত্বে ভূদেব খেটো। বোলতার লোক ইতিমধ্যে জেনে গেছে সরানন্দ মহাপাত্র আসলে স্বরাজ দাস।
গম্ভীর চালে বড়বাবু সরাকে বললেন, ”শুনলুম তুমি প্রমাণ করেছ গড়ের মাঠে, পাতালঘরে ভূত নেই। এটা কি সত্যি?”
একগাল হেসে সরা বলল, ”আজ্ঞে হ্যাঁ। এটাও সত্যি, ভূতেই টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।”
”তা হলে মিথ্যে ডাকাতির অভিযোগ করেছিলে। জানো এর ফল কী হতে পারে?”
”কী আবার হতে পারে।” গর্জন করে ভূদেব এগিয়ে এলেন। ”বংশীবদন আগে ঘরে উঠুক, তারপর ফলটল দেখাবেন।” মুঠোকরা হাত তুলে জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি কথা শেষ করলেন, ”কী বলো হে তোমরা?”
হইহই করে উঠল জনগণ।
”পুলিশের জুলুম চলবে না।”
”থানা ঘেরাও করব।…দাদু কালই বোলতা বনধ ডাকুন।”
”এসব বোলতাকে হারাবার জন্য ছ’গোল খাওয়া বিদ্যুৎপুরের চক্রান্ত। তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বড়বাবু।”
”বড়বাবুর কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।”
এক পা এক পা করে পিছু হটে যাচ্ছেন বড়বাবু। দরদর ঘাম গড়াচ্ছে কপাল থেকে গাল বেয়ে। জনতাও এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর দিকে।
মেজোবাবু ফিসফিস করে বললেন, ”সার, বংশীবদনের আহ্বানে, বোলতার জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে, স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য—”
”আঃ, কী খটোমটো বাংলা বলছ।” বড়বাবু ধমক দিলেন। তারপর হাত জোড় করে জনতাকে উদ্দেশ করে বললেন, ”স্বরাজ দাস বলেছে ভূতে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। ব্যস, আর কোনও সমস্যা নেই। তা হলে এবার আমাদের যেতে দিন।”
”যেতে দাও, যেতে দাও,” বলে ভিড় পথ করে দিল। ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে এসেই বড়বাবু খিঁচিয়ে উঠলেন, ”পাবলিকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি? এইজন্যই তো পুলিশের এত বদনাম।” পরশু ফাইনাল খেলা লিচুতলা সহযাত্রীর সঙ্গে। সরা বাড়ির দিকে রওনা হতেই জনতা তার সঙ্গ নিল।
”যাক বাবা, একটা ফাঁড়া কাটল,” দোতলার বারান্দায় সুশি বলল।
.
সাদা মারুতি গাড়িটা সরাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে থামল, চালাচ্ছেন পতিত ভটচায, তাঁর পাশে সত্যশেখর, পেছনে কালো শার্ট পরে সেই যুবকটি, যার হাঁটা দেখলেই মনে হয় বগলে ফোঁড়া হয়েছে। ওর নাম বদু। আর আছে বিশ্বনাথ ওরফে বিশুবাবু, শ্যামপুকুর ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ। বদু এবং বিশুবাবু সরাদের বাড়িতে আগে এসেছে।
গাড়ি থেকে সবাই নামল। বিশুবাবুর হাতে পাতলা একটা অ্যাটাচি কেস। সে বলল, ”বদু, তুই যাসনি, গাড়িতে থাক। দরকার হলে ডাকব।”
”কেন বিশুদা, দানাটানা খাওয়াবার কথা বলতে হবে না? সঙ্গে করে এনেচি।”
”না, না, ওসব আজ নয়।” বিশুবাবু ওকে থামাল।
বদু বলল, ”চলো, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।”
সামনে দু’জন পেছনে তিনজন বাবার সড়ক থেকে সরু একটা রাস্তা ধরে এগোল। তখন সুমি সামনের বাড়িতে এক বউকে ডাকাতির গল্প শোনাচ্ছিল। তিনজন সরাদের বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার পর বদু রাস্তায় পায়চারি শুরু করল। গল্প করতে—করতে জানলা দিয়ে তাকিয়ে সুমির চোখে পড়ল কালো জামাপরা সেই লোকটাকে, যে কয়েকদিন আগে তাদের পিস্তল দেখিয়ে দানা খাওয়াবে বলে গেছল।
”বউদি, ওই তো সেই ডাকাতটা। আবার আমাদের বাড়িতেই এসেছে। ওরে বাবা, এখন কী হবে! কেউ নেই বাড়িতে দিদি আর মা ছাড়া।”
বউদি জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে বদুকে দেখে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, ”ডাকাত, ডাকাত…ওগো কে কোথায় আছ, ডাকাত পড়েছে…বাঁচাও, বাঁচাও।”
পাড়ায় সবাই জানে দু’দিন আগেই ডাকাতি হয়ে গেছে। পাড়ায় এত বাড়ি, এত লোক থাকতেও কিনা পরিচ্ছন্নভাবে ডাকাতিটা করে সটকে পড়ল! ডাকাতটাকে ধরা গেল না। এজন্য সারা পাড়ার নারীপুরুষ খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ে। বউটির চিৎকার শুনে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে এল, তবে তারা পুরুষ নয়। তখন বেলা প্রায় দশটা বাজে, পুরুষরা কাজেকর্মে বেরিয়ে গেছে। নানান বয়সী মেয়ে, তাদের হাতে খুন্তি, কাটারি, চ্যালা কাঠ, লোহার শিক। এমনকী ইটের খণ্ড, মাটির ঢেলা।
বদু প্রথমে বুঝতে পারেনি রে রে করে যারা তেড়ে আসছে তাদের লক্ষ্য সে নিজেই। একটা মাটির ঢেলা তার মাথায় লেগে ভেঙে যেতে সে সচকিত হয়ে পালাবার জন্য এধার—ওধার তাকাল।
”ডাকাত, ডাকাত,” চিৎকারে দাসপাড়া মুখর। তার মধ্যেই একজন বলে উঠল, ”শিগগিরি থানায় গিয়ে খবর দে।”
ফ্রকপরা দুটি মেয়ে ছুটল থানার দিকে। আর বদু ছুটল বাবার সড়ক ধরে। এখানে সে কিছুই না চিনলেও এখন তার মনে পড়ছে সুশিদের বাড়িটা। সেখানে গিয়ে আপাতত লুকিয়ে থাকা যায়। তাই সে ছুটল সুশিদের বাড়ির দিকে।