মেজোবাবু বললেন, ”সার, ডাকাতিটা জেনুইন কিনা সেটা কখন জানব?”
”কাল সকালে। কলাবতীর গড়ের মাঠে ভূত দেখতে যাওয়াটাও রহস্যময় ঠেকছে। ব্যাংবাবু, কাল সকালে আমি আসছি, ওকে বাড়িতে থাকতে বলবেন। এখন আমরা যাচ্ছি।”
বড়বাবুরা চলে যাওয়ার পর ব্যাংকাকা জিজ্ঞাসা করলেন, ”কলাবতী কোথায় রে, সুশি?”
”পাতালঘরে। তোমার টর্চটা দাও তো ওকে ডেকে আনি। রাতটা মিছিমিছি কেন আর ওখানে কাটাবে?”
”হঠাৎ পাতালঘরে কেন?” বিভ্রান্ত ব্যাংকাকা হাঁ করে রইলেন।
”পরে বলব।”
রাতটা কলাবতী দোতলার পালঙ্কে শুয়েই কাটাল। সকালে চিড়ে দুধ আম ফলার করে পাতালঘরে যাওয়ার আগে সে বলল, ”সুশি, একটা গল্পের বই দে তো। সময় কাটাতে বড় কষ্ট হয়।”
”কাকা তো গল্পের বইটই পড়ে না। একটা অভিধান আছে দেখেছি, বাংলা থেকে বাংলা, ওটাই নিয়ে যা, অনেক শব্দ শিখতে পারবি।”
কলাবতী অভিধান হাতে পাতালঘরে নেমে গেল। সুশি ছিপ নিয়ে বসল মাছ ধরতে। বড়বাবু সকালে আসবেন বলেছিলেন, তার বদলে এল সরা।
”কলাবতী কোথায়” সুশিকে সে জিজ্ঞেস করল। ”জানো, আজ ভোরবেলা থানা থেকে আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিল। বলে কিনা ডাকাতি যে হয়েছে তার প্রমাণ কই? আরে ডাকাতরা কি প্রমাণ রেখে ডাকাতি করে? কোথায় কলাবতী? প্রমাণ করে দোব কে ডাকতি করেছে।”
সুশি তেরিয়া গলায় বলল, ”কলাবতীকে কী দরকার? তুমি কি বলতে চাও একটা মেয়ে তোমাদের বাড়িতে ডাকাতি করেছে?”
”মেয়ে ডাকাত কি হয় না? ফুলন দেবী? আমি একশো পার্সেন্ট শিওর কলাবতী ডাকাত সেজে টাকাটা নিয়ে গেছে। ও মেয়ে সব পারে। ওর দাঁত, ওর নাক, ওর নখই প্রমাণ।”
”একটা মিথ্যেবাদীর কথা পুলিশ বা কোর্ট মানবে ভেবেছ? তুমি মিথ্যে ডায়েরি করে বলোনি টোকেন হারিয়ে গেছে?” কথাটা বলে সুশি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল সরার দিকে। কী একটা বলতে গিয়ে সরা ঢোক গিলল।
”টোকেনটা কালুর কাছে তুমি লুকিয়ে রেখে দিয়েছ। তেমনই কালুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ওকে দিয়ে ডাকাতি করিয়েছ। অ্যাটাচি কেসটা তুমি কোথাও লুকিয়ে রেখেছ। কলাবতীকেও তুমি কোথাও সরিয়ে দিয়েছ কিংবা গুম করেছ। এসব কথা তো এখনও পুলিশকে বলিনি।” সুশি মাছ ধরার সময়ই ভেবে ঠিক করেছে কলাবতীকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে হলে সরাকেই পালটা ধাক্কা দিতে হবে। এজন্য একটা—দুটো মিথ্যে কথা বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয় যদি হোক। সে ভেবে ঠিক করে ফেলে, সব দোষ সরার ঘাড়ে চাপিয়ে ওকে কোণঠাসা করে দেখবে চুপসে যায় কি না। এটা তো সত্যি, সরা দুটো মারাত্মক অন্যায় করেছে—মিথ্যে ডায়েরি আর দুটো ক্লাব থেকে অ্যাডভান্সের টাকা নেওয়া।
সরা চুপসে গেল না, ভেঙে পড়ল। রকের ওপর উবু হয়ে বসে দু’হাতে ন্যাড়া মাথাটা চেপে ধরল। ”এইসব ডাহা মিথ্যে কথা তুমি বলবে?”
”বলব। যদি তুমি কালু সম্পর্কে পুলিশকে আর একটা কথাও বলো, তা হলে বলব।”
সরা একদৃষ্টে উঠোনে পাঁচিলের ধারে নয়নতারা গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মনে কী আলোড়ন চলছে সুশি তা বোঝার চেষ্টা করতে—করতে নরম গলায় বলল, ”আমরা তো তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতেই চাই। কালু যা কিছু করেছে সব তো তোমার ভালর জন্যই। তোমার বাবা—মা তো টাকা দিতে চাইছিল না। তাই তো ডাকাত সেজে টাকাটা ও এনেছে, শ্যামপুকুরকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই। কালই ও কাকাকে ফোন করেছে। ব্রাদার্সের পতিত ভটচায কাকার খুব পরিচিত। তাকে দিয়ে শ্যামপুকুরের সঙ্গে মিটমাট করে টাকাটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলেছে তো কালুই। এবার কি ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে?”
সরা চোখ ছলছল করে উঠল। ধরা গলায় সে বলল, ”এত সব কাণ্ড করেছে আমি কিছু জানতুম না। এখন আমি বড়বাবুকে কী বলব?”
”বলবে, টাকাটা পাওয়া গেছে। ডাকাতটা অ্যাটাচি কেসটা গড়ের মাঠে ফেলে ভূতের ভয়ে পালিয়ে গেছে। কলাবতী সেটা কুড়িয়ে পেয়েছে।”
শুনতে—শুনতে সরার মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল। ”বুঝেছি, কলাবতী তা হলে ওখানে।” কথাটা বলেই সে তীরবেগে ছুটল পাতালঘরের দিকে, তার পিছু—পিছু সুশি।
পাতালঘরের গর্তের কাছে দাঁড়িয়ে সরা, ”কলাবতী, কলাবতী” বলে তিন—চারবার ডাকল। কোনও সাড়া এল না। মইটা লাগানোই রয়েছে। সরা নেমে গেল পাতালঘরে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে বলল, ”আমি পুলিশকে কিছু বলব না কলাবতী, তুমি বেরিয়ে এসো।” কিন্তু কলাবতীর কোনও সাড়া নেই। সে অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে কুঁজোয় ঠোক্কর খেল। তারপর পায়ে লাগল টর্চটা। সেটা তুলে নিয়ে জ্বালল, চারদিকে ঘুরিয়ে—ঘুরিয়ে দেখল, কয়েকটা চামচিকে ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই।
সে ওপরে উঠে এসে অবাক স্বরে সুশিকে বলল, ”ভেতরে কেউ নেই। গেল কোথায়?
দুর্ভাবনা ফুটে উঠল সুশির চোখে, গলার স্বরে। ”ওর তো এখানেই থাকার কথা! যাবে কোথায়? অ্যাটাচিটা দেখলে কী?”
”না, নেই।”
ওরা গড়ের মাঠে ঘুরে—ঘুরে ঝোপঝাড় দেখল। গড়ের বাড়ির ভাঙা দেওয়ালের এধার—ওধার খুঁজল। কয়েকবার নাম ধরে ডাকল। তারপর দিঘির পাড় ধরে এগিয়ে গেল, যদি জলে পড়ে গিয়ে থাকে।
”কী রে সুশি, বড়বাবু আসবে কখন?”
দু’জনেই চমকে উঠে দিঘির দিকে তাকাল। জলে নলখাগড়ার বনের মধ্যে নৌকায় বসে কলাবতী। হাতে অভিধানটা।
”অনেকক্ষণ নৌকোয় বসে ‘অ’—টা এখনও শেষ হল না। অক্ষত মানে আতপ চাল, অয়স মানে লোহা, অররু মানে শত্রু, অষ্টাপদ মানে সোনা—আর শুনবি? কী দারুণ ইন্টারেস্টিং বই, এতদিন জানতুমই না।…বড়বাবু চলে গেলে বলিস।”