সুশি চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত ভেবে শান্ত গলায় বলল। ”পাতালঘর।”
”তার মানে!”
”মানে অ্যাটাচি কেস, মাদুর—বালিশ, টর্চ এইসব নিয়ে তুই পাতালঘরে নেমে পড়। মইটা এখনও গর্তে লাগানো আছে বোধ হয়। চটপট কর। তুই এগো, আমি জিনিসপত্তর নিয়ে যাচ্ছি। আর ঘন্টু শিগগিরি রাঙাদার কাছে যাও, ওর মেকআপ বক্স থেকে ছোরা পিস্তল দাড়ি ঝুলপি সব সরিয়ে ফেলতে বলো। বলা যায় না পুলিশ ওর কাছেও যেতে পারে।”
কলাবতী পাতালঘরে নেমে যাওয়ার মিনিট দুই পরই থানার বড়বাবু, মেজোবাবু আর দু’জন কনস্টেবল হাজির হল, সঙ্গে ব্যাংকাকা। তাঁকে ক্লাবঘর থেকে ওঁরা প্রায় গ্রেফতারই করে এনেছেন।
”কী অদ্ভুত কাণ্ড দ্যাখ তো সুশি। বড়বাবু বলে কিনা বাড়িতে ডাকাত রয়েছে, সাড়ে তিন লাখ টাকা ডাকাতি করেছে, বাড়ি সার্চ করবে।” মাথায় হাত দিয়ে তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন।
”তোমার নাম কী? সুশিকে বড়বাবুর প্রশ্ন।
”সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”
”কলাবতী কার নাম?” বড়বাবু ধমকের সুরে জানতে চাইলেন।
”আমার বন্ধুর নাম।”
”কোথায় সে?”
”ওর খুব ভূত দেখার শক, তাই গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে গেছে।”
বড়বাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। ”কী বললে? গড়ের মাঠে? ওখানে দিনের বেলাতেই লোকে যায় না, আর রাত্তিরে হাওয়া খেতে গেছে? বললেই হল?” তিনি মেজোবাবুকে নির্দেশ দিলেন, ”তন্নতন্ন করে সার্চ করুন। বড় অ্যাটাচি কেস। আলমারি খুলে দেখবেন, খাটের তলা দেখবেন। তারপর গোয়ালঘর, তারপর রান্নাঘর। ব্যাংবাবু আপনিও ওদের সঙ্গে যান।”
মেজোবাবু দুই কনস্টেবলকে নিয়ে সার্চে যাওয়ার আগে বললেন, ”সার এই মেয়েটি, এর সঙ্গে আর একটি মেয়ে আর ছেলেকে কাপড়ের দোকানে দেখেছি ফোন করার সময়। বোধ হয় ফোন করতে গেছল।”
বড়বাবু নীচের ঠোঁচ কামড়ে বললেন, ”আর—একটা ক্লু পাওয়া গেল। কাকে ফোন করতে গেছলে?”
সুশি গম্ভীর মুখে বলল, ”কালু ফোন করতে গেছল ওর কাকাকে। কাকার বন্ধু পুলিশের ডি জি, তাকে একটা খবর দিতে।”
বড়বাবুর দেহ সটান হয়ে গেল। চোখের পাতা ঘন ঘন পড়ল। গলার স্বর বদলে গেল। ”ডিই জিই! কেন, কীজন্য, কী খবর দিতে?”
”এত বড় একটা ডাকাতি হল আর কিনা থানার ফোন খারাপ, জিপ ভাঙা!”
”তা আমি কী করতে পারি। আমি তো আর খারাপ করে রাখিনি বা ভেঙে দিইনি।”
”আমিও ঠিক তাই বললুম কালুকে। বড়বাবু তো আর কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এসব করে রাখেননি। উনি খুব কাজের লোক।”
”এটা কি কলাবতী ডি জি—কে বলেছে?”
”অবশ্যই বলেছে। আরও বলেছে, ডাকাতরা ক’দিন আগেই সরাদের বাড়িতে গিয়ে থ্রেট করে বলে গেছে টাকা না পেলে দানা খাইয়ে দেবে। সেটা কি আপনি জানেন?”
”আজ জানলুম স্বরাজ দাসের মায়ের কাছে।”
”কেন, সেইদিনই থানায় গিয়ে জানায়নি? এত বড় একটা হুমকি দিয়ে গেল সেটা কি পুলিশকে না জানিয়ে থাকা যায়? এর মধ্যে একটা রহস্য আছে বলে কি আপনার মনে হচ্ছে না? আসলে ডাকাতরা সরাদের খুবই পরিচিত তাই থানাকে জানায়নি।”
”হুমম।” বড়বাবু ঘোরতর চিন্তায় পড়ে গেলেন। ”সেদিনই জানালে আমরা ওয়াচ রাখতে পারতুম, পুলিশ পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করতুম।”
”ঠিক এই কথাগুলোই কালু বলেছে ওর কাকাকে। কাকা বলেছেন কালই ডি জি—কে জানিয়ে দেবেন, সরার বাড়ির সবাইকে আচ্ছাসে জেরা করার জন্য বোলতার বড়বাবুকে যেন ইনস্ট্রাকশন দেন।”
”দেবেন কী করে, ফোনই তো খারাপ। তবে ফোন না করলেও জেরা তো অবশ্যই করব। আমার এলাকায় ডাকাতরা এসে দানা খাওয়াবে বলে গেল আর আমি কিনা জানতে পারব না? হুঁউউ মনে হচ্ছে রহস্য আছে।” বড়বাবু নাক টিপে ধরে চোখ বুঝে মাথা নাড়লেন।
সুশি এবার গলা নামিয়ে বলল, ”আর একটা কথা কি আপনার মনে হয়নি, সত্যি—সত্যিই কি আজ ডাকাতি হয়েছে ওদের বাড়িতে? কালুর কাকা বড় ব্যারিস্টার, তিনিও প্রশ্নটা তুলেছেন।”
”অ্যাঁ!” বড়বাবু যেন অগাধ জলে পড়লেন। ”ডাকাতি হয়নি?”
”শ্যামপুকুর ক্লাবকে ফলস দেওয়ার জন্য মিথ্যে করে বানিয়ে বলতেও তো পারে, পারে কিনা বলুন?”
”হুমমম।”
”ডাকাতিটা নিজেরাও তো কাউকে দিয়ে করাতে পারে, পারে কিনা বলুন? মা আর মেয়ে ছাড়া বাইরের কোনও লোক কি দেখেছে?”
”হুমমম।”
”স্বরাজ দাস ফলস নামে, মাথা ন্যাড়া করে আজ খেলল কেন? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনও রহস্য আছে।”
বড়বাবু আর থই পাচ্ছেন না। ফ্যালফ্যাল করে সুশির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মেজোবাবু সদলে ফিরে এলেন। ”সার, কোথাও কিছু পেলাম না।”
”পাবেন কী করে!” বড়বাবু হতাশ স্বরে বললেন, ”ডাকাতি সত্যি—সত্যি হয়েছে কিনা সেটা কি আপনি জেনেছেন?”
”না তো!” মেজোবাবু থতমত।
”জানা উচিত। একজন বড় ব্যারিস্টার, ডি জি—র বন্ধু পয়েন্টটা তুলেছেন। তবে এসেছি যখন কলাবতীর সঙ্গে অভিযোগের বর্ণনার মিল কতটা সেটা একবার দেখে নেওয়ার দরকার। ওকে ডাকো তো।” বড়বাবু সুশিকে বললেন।
”এই রাত্তিরে আমি গড়ের মাঠে যাব ডাকতে? আপনিই তো বললেন দিনের বেলাতেও লোকে যায় না।”
”তা হলে বলাই তুমি গিয়ে ডেকে আনো।” বড়বাবু একজন কনস্টেবলকে নির্দেশ দিলেন।
”আমি স্যার!” বলাই ঢোক গিলল। ”এখানে থেকে চেঁচিয়ে ডাকব?”
”এখান থেকে নয়, সদর দরজার বাইরে গিয়ে ডাকো।”
বলাই বাইরে গিয়ে দু’হাতের চেটো মুখের দু’পাশে রেখে ”কলাবতী, কলাবতী” বলে পাঁচবার চিৎকার করে ফিরে এল।