”মজা দ্যাখ না!”
”হ্যালো, হ্যালো, রসবেড়িয়া থানা? আমি বোলতা থানার মেজোবাবু। এখানে সাড়ে তিন লাখ টাকার ডাকাতি হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। মোটরবাইকে টাকাসমেত পালিয়েছে আপনাদের এলাকার দিকে। কালো জামা, কালো চশমা, দাড়িও আছে। অ্যাঁ কত বড় দাড়ি? রামছাগলের মতো…ফায়ার আর্মস? পিস্তল, ছোরা…।
সুশি চেঁচিয়ে বলল, ”পিঠে একটা মোটাসোটা বন্দুক দেখেছি বাঁধা ছিল।”
”হ্যালো, হ্যালো, একজন বলছে, সঙ্গে এ কে ফরটিসেভেন আছে।…অ্যাঁ? আপনি এখন ভীষণ ব্যস্ত? গোরুচোরকে জেরা করছেন!” মেজোবাবুকে হতাশ দেখাল। রিসিভারটা রাখতে রাখতে বলল, ”এ কে ফরটিসেভেন না বললেই হত।”
মেজোবাবু চলে যাওয়ার পর কলাবতী বুথে ঢুকল। মাত্র দু’বারের চেষ্টায় লাইন পেয়ে সে সত্যশেখরকে তার সেরেস্তায় পেল।
”কাকা, আমি কালু, বোলতা থেকে বলছি।…খুব ভাল আছি। দাদু চলাফেরা কেমন করছে?…নীচে নামছে! এবার কাজের কথা, একটা সাহায্য চাই। তুমি হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট পতিত ভটচাযকে চেনো? ব্রাদার্স ইউনিয়নের সেক্রেটারি…চেনো? খুব আলাপ! তা হলে তো ভালই হল। এবার শোনো—।”
কলাবতী খুব দ্রুত গতকাল থেকে সরাকে নিয়ে যা—যা ঘটেছে বলে গেল। ”এখন যা করতে হবে সরাকে নিয়ে দুটো ক্লাবে যে জট পাকিয়েছে সেটা ছাড়ানো অর্থাৎ মিটমাট।” কলাবতী দেখে নিল দোকানদার কতদূরে, সুশি তাকে ব্যস্ত রেখে আলমারি থেকে শাড়ি পাড়াচ্ছে। একটু গলা নামিয়ে কলাবতী বলল, ”টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্য রেডি। সরার মন ব্রাদার্সে পড়ে আছে ওকে নিয়ে শ্যামপুকুরের কোনও লাভ হবে না, ওকে ওরা ছেড়ে দিক। মনপ্রাণ দিয়ে শ্যামাপুকুরে খেলা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। শ্যামপুকুরের ব্রজদাকে এটা বুঝিয়ে বলুক পতিত ভটচায। মনে হয় রাজি হয়ে যাবে। ওরা টাকাটা ফিরিয়ে নিয়ে ওর সই করা যে সব কাগজপত্তর আছে ফিরিয়ে দিক। তরশু এখানে ফাইনাল ম্যাচ। সরা খেলবে। তার আগেই ব্যাপারটা চুকে গেলে ও খোলা মনে খেলতে পারবে। এগেনস্টে তারকেশ্বর ইয়ুথ, খুব কড়া টিম। বোলতার বংশীবদন শিল্ডটা জেতা খুব দরকার নয়তো ভূতের বাসা ভাঙা যাবে না। ব্রজদা বা ওদের কেউ পরশুই সুশিদের বাড়িতে এসে, বাড়িটা ওদের লোক চেনে, সব কিছু চুকিয়ে দিয়ে যাক।”
আরও দু—চারটে কথা বলে ফোন রেখে কলাবতী বুথ থেকে বেরিয়ে এসে দেখল সুশি দুটো ধনেখালি তাঁতের শাড়ি বেছে রেখেছে।
”টাকা তো সঙ্গে আনিনি, আপনি আলাদা করে রেখে দিন, কাল এসে নিয়ে যাব।” সুশি বলল দোকানিকে। ”কালু, কাকার সঙ্গে সব কথাবার্তা হয়ে গেছে?”
.
কলাবতী ঘাড় নেড়ে এসটিডি—র জন্য ব্যাগ থেকে টাকা বার করছিল, সুশি বাধা দিল। ”কী কথা হয়েছিল মনে নেই? কাঁকুড়গাছিতে না ফেরা পর্যন্ত সব খরচ আমার। ঘন্টু, এখানে কোন দোকানে সন্ধেবেলায় গরম—গরম রসগোল্লা পাওয়া যাবে?”
”মহাদেবের দোকানে।”
তিনজনে মহাদেবের দোকানে এসে শুনল রসগোল্লা শেষ হয়ে গেছে। বোলতা স্পোর্টিং ফাইনালে ওঠার সুখ তারিয়ে—তারিয়ে উপভোগ করেছে জনগণ, ভূদেব খেটোর দাক্ষিণ্যে।
বাড়ি ফিরেই ওরা জনাদার কাছে শুনল, সরা উধাও। কে যেন ওকে বলেছে বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। তাই শুনেই সে ছুটে বেরিয়ে গেছে।
”যাক, তা হলে, হাঁটুর জন্য ভয়টা আর নেই।” সুশি আশ্বস্ত গলায় বলল, ”তবে টাকাটার জন্য সরা আবার আর এক দুর্ভাবনায় পড়বে। ওকে কি বলা উচিত কে ডাকাতি করেছে?”
কলাবতী আঁতকে উঠে বলল, ”একদম নয়। শ্যামপুকুর টাকা ফেরত নেওয়ার আগে পর্যন্ত কিছুতেই নয়।”
”আমি একবার সরাদের বাড়ি ঘুরে আসি,” ঘন্টু কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল।
.
আধঘণ্টা পর ঘন্টু হাঁফাতে—হাঁফাতে ফিরে এল।
”করেছ কী?” কলাবতীকে সে বলল। রেকর্ডারে বাজছিল হ্যারি বেলাফন্টের ক্যাসেট। সেটা বন্ধ করে কলাবতী ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, ”কী করেছি?”
”এত বড় হাঁ করে হা হা হা করে হেসেছিল? তুমি জানো না তোমার ডান কষের ওপরের পাটির একটা দাঁত নেই?”
কলাবতী ডান গালে হাত দিয়ে বলল, ”নেই। নড়ছিল তাই একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় টান মেরে ফেলে দিয়েছি।”
”এখন সেই টান মারার হ্যাপা সামলাও। সরার ছোড়দি দেখেছে তোমার একটা দাঁত নেই। তোমার নাকের ওই নাকছাবি পরার ফুটোটাও ওর চোখে পড়েছে। যখন ছোরাটা পেটে চেপে রেখেছিলে তখন ছোড়দি লক্ষ করেছে তোমার ডান বুড়ো আঙুলের নখটা খুব বড়।”
কলাবতী আঙুল তুলে চোখের সামনে ধরে শিউরে উঠে বলল, ”সত্যিই তো! অনেক কাজে লাগে বলে নখটা বড় রেখেছি।”
অধৈর্য সুশি বলল, ”তারপর কী হল? ওরা তো কালুকে চেনে না, জানে না, আগে কখনও দ্যাখেওনি। কিন্তু কালুর দাঁত, নাক, নখ তো সরা দেখেছে। তার ওপর সুশীলপরসাদ ঘন্টেলাল শুনেই ওর মাথায় সুশি—ঘন্টু নাম দুটো ধাক্কা দিয়েছে।”
”ইসস, খুব বোকামি হয়ে গেছে। সরা এখন কী করবে?” আফসোসে কলাবতীর গলা বসে গেছে। ”যদি পুলিশকে বলে দেয়?”
”দেয় কী, দিয়েছে!” ঘন্টুর স্বরে আতঙ্ক।
”তা হলে তো পুলিশ এখানে আসবে।” কলাবতী বলল। ”সুশি, কী করা যায়?”
”কী আর করার, তুই হাওয়া হয়ে যা। আমরা দু’জন থেকে যাচ্ছি। সন্দেহটা তো তোকেই।”
”কীভাবে এই রাত্তিরে হাওয়া হব! আমি তো রাস্তাঘাট চিনি না। সড়ক তো বন্ধ করে দিয়েছে!”