ভূদেব খেটোর সঙ্গে গেল জনাদশেক।
ব্যাংকাকা ব্যস্ত হয়ে ভিড়ের মধ্যে জনাকে খুঁজে বার করলেন। ”মই, মই।”
বিরক্ত হয়ে জনা বলল, ”এখন কোথায় খই পাব?”
”সিঁড়ি—সিঁড়ি।” হতাশ ব্যাংকাকা কপাল চাপড়ালেন। হইহট্টগোলের মধ্যে জনা চেঁচিয়ে বলল, ”পিঁড়ি এনে দিচ্ছি।”
ব্যাংকাকা এবার নিজেই মই আনতে ছুটলেন।
কলাবতী বলল, ”অ্যাটাচি খুলে দেখে নিতে হবে সাড়ে তিন লাখ ঠিক ঠিক আছে কিনা।”
”খুলবি কী করে,” সুশি বলল, ”ওটার তো চাবি দেওয়া। লকটা তা হলে ভাঙতে হবে, ভাঙব?”
”না, না, এখন থাক, পরে দেখা যাবে। ঘন্টু তো নীচে চলে গেল, যাবি ওদের সঙ্গে পাতালঘর দেখতে?”
”না। এখন একটু আড়ালে থাকাই ভাল। এসটিডি করতে যাবি তো? শাড়িটা পরে নে। টিপ পর, আমার চুড়ি দুটো হাতে গলা। ডাকাতের চিহ্ন যেন কোথাও না থাকে,” সুশি পরামর্শ দিল। ”সরাদের বাড়ি থেকে নিশ্চয় থানায় খবর দেবে। সাবধানে থাকতে হবে।”
নিখুঁত মেয়ে সেজে কলাবতী বারান্দায় এসে দাঁড়াবার পর কথা বলতে বলতে পাতালঘর দেখে ওরা ফিরে আসছে।
”সরানন্দ কীরকম সরসর করে নেমে গেল মই দিয়ে, একটুও ভয় করল না।”
”যেভাবে নামল, যেন জায়গাটা ওর খুব চেনা।”
”ওই কি নামা? সরসর করে কেমন বাংলা বলল!”
”শ্যামপুকুর কি ব্রাদার্স ইউনিয়ন ডেফিনিটলি ওকে তুলে নেবে, দেখে নিস।”
”এতকাল কীসব বাজে কথা আমরা বিশ্বাস করে এসেছি!”
বাইরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে ফলাফল জানার জন্য। ওরা বাড়ি থেকে বেরোতেই, ”কী দেখলি রে…পাতালঘর সত্যি আছে?” এইসব বলে ওদের ঘিরে ধরল। কলাবতী শুনল একজন চেঁচিয়ে বলছে, ”ভূতপ্রেত সব বাজে কথা। কালকেই সরানন্দ মহাপাত্রকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হোক। আমাদের দাবি, মাঠ চাই, কলেজও চাই।”
ভিড়ের থেকে কে বলল, ”বংশীবদনও চাই।”
স্লোগান উঠল, ”মাঠ নাও, কলেজ দাও।”
”বোলতা তুমি বংশী বাজাও।”
নীচের থেকে ঘন্টু উঠে এল। ”তোমরা রেডি। ভিড়টা চলে যাক তারপর বেরোব। যাক, সরা এবার ছাড়া পাবে। টাকাটা তো ফেরত দিতেই হত, যাদের পাওয়ার কথা তারাই পাবে।”
সুশি বলল, ”কোনও অন্যায় আমরা করিনি, করেছিল সরার মা। টাকাটা ধরে রেখে ছেলেরই ক্ষতি করছিল। ওর ট্রান্সফার নেওয়াও আটকে গেছে দুই ক্লাবের দাবিতে।”
কলাবতী বলল, ”তার থেকেও বেশি, বোলতার এতদিনকার ভূতের ভয়টা তো ভাঙল। কলেজও হবে।”
ঘণ্টু বলল, ”বলাবলি হচ্ছিল, এবারের গাজন মেলাটা গড়ের মাঠেই বসাবে। শিবমন্দিরটাও সরিয়ে শিবপ্রতিষ্ঠা করবে।”
মিনিটদশেক পর ভিড় সরে যেতে ওরা তিনজন বাজারের দিকে রওনা হল। বোলতা বস্ত্রালয় বেশ বড় দোকান। নানারকম শাড়ি, শার্টিং ও সুটিংয়ের কাপড়ও বিক্রি হয়। টানা কাউন্টারের পেছনে কাচের আলমারি। দোকানে ঢোকার মুখেই এসটিডি—র কাচের বুথ, ফোন করছে খাকি শার্ট প্যান্ট পরা একজন। ভুঁড়ি দেখেই বোঝা যায় পুলিশের কেউ।
ঘন্টু মালিকের কাছে গিয়ে বলল, ”কলকাতায় একটা ফোন করবে ব্যাংজ্যাঠার ভাইঝি।” সে আঙুল দিয়ে কলাবতীকে দেখাল।
”থানার ফোন খারাপ, এখন এস পি—কে জরুরি ফোন করছেন মেজোবাবু, ওঁর করা হয়ে যাক। একটা বড় ডাকাতি হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক আগে।” মালিক বলল।
ঘন্টু অবাক হয়ে বলল, ”তাই নাকি? কোথায়?”
”দাসপাড়ায়।”
কলাবতী আর সুশি শুনতে পাচ্ছে চেঁচিয়ে বলা মেজোবাবুর কথাগুলো।
”হ্যাঁ সার, বাবার সড়ক সিল করে দেওয়া হয়েছে। বড়বাবু এখন ডাকাতির স্পটে রয়েছেন। মোটরসাইকেলে দু’দিন আগে এসে থ্রেট করে গেছল…বোধ হয় তাদেরই কাজ। একটা বড় গ্যাং এসেছিল জনাসাত—আটের। বাইরে অপেক্ষা করছিল।…বাড়িতে ছিল শুধু মা আর মেয়ে…ডাকাতটা দু’জনের নাম বলেছে সুশীল পরসাদ আর ঘণ্টেলাল।…হ্যাঁ সার ইউ—পি কি বিহারের…শুধু পিস্তল আর ছোরা…এ কে ফরটিসেভেন ছিল না। খবরটবর নিয়েই মনে হচ্ছে ডাকাতিটা করেছে। …না সার থানার জিপের গিয়ার বক্সটা চারদিন হল ভেঙে রয়েছে তবে সাইকেল রিকশায় দু’জন কনস্টেবল টইল দিচ্ছে আর দু’জন পাড়ার সব বাড়িতে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে।…ডেসক্রিপশন যা দিয়েছে তাতে মনে হয় রেলডাকাতি করে, অন্তত ডজনখানেক মার্ডার করেছে। কাল আপনি আসছেন?…বাড়িতে পুলিশ পোস্টিং? বড়বাবুকে নিশ্চয় বলে দোব। হাঁ সার, বড় ডাকাতি এখানে আগে হয়নি।…নমস্কার, নমস্কার।”
রুমালে কপালের ঘাম মুছে মেজোবাবু দোকানির দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ”আজ আসতে পারবেন না, রাইটার্সে পুলিশমন্ত্রীর কনফারেন্স থেকে এইমাত্র ফিরলেন, টায়ার্ড!” তারপর ঘন্টুর দিকে ফিরে বলল, ”বিকেলে মোটরবাইকে কালো জামা, কালো চশমা পরা ছাগল দাড়িওলা কাউকে বাবার সড়কে যেতে দেখেছ?”
”আমি তো মাঠে খেলা দেখছিলুম।” নিরীহ ভীতমুখে ঘন্টু বলল। মেজোবাবু সুশির দিকে তাকাতেই সে বলল, ”বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা ওইরকম কালো জামা পরা লোককে বাইকে চড়ে পুবদিকে যেতে দেখেছি।”
মেজোবাবু উৎসাহে দু’হাতের তালু ঘষে উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠলেন, ”এই তো ক্লু পেয়ে গেছি। পুবদিকে গেছে? তার মানে রসবেড়িয়া থানার এলাকায় ঢুকেছে। ওদের তা হলে অ্যালার্ট করে দিতে হবে।”
মেজোবাবু লাফ দিয়ে ফোনের বুথে ঢুকে ডায়াল করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”আবার ঝামেলা বাড়াতে গেলি কেন?”