ঘন্টু সাইকেল ধরে রয়েছে। কলাবতী উঠে বসে ভারী অ্যাটাচি কেসটা ডান হাতে ঝুলিয়ে বাঁ হাতে হ্যান্ডেল ধরে প্যাডেলে পা রাখল। ঘন্টু সাইকেলটা ধরে ঠেলতে ঠেলতে কিছুটা ছুটে গিয়ে ছেড়ে দিল। প্রথমে টলোমলো হওয়ার পরই ব্যালান্স ঠিকমতো পেয়ে গিয়ে সাইকেল সোজা হয়ে গেল। সুশি আর ঘন্টু তাকিয়ে দেখল দূরে একটা বাঁক ফিরে কলাবতী অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এবার তারা বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। রান্নাঘরের দরজায় দুমদাম কিল আর লাথির শব্দ, সেইসঙ্গে হাউমাউ চিৎকার তখন তাদের পেছনে। ওরা যখন বাড়ি পৌঁছল তখন ”হোওওও”—র বদলে আওয়াজ উঠল ”হাআআআ”। ঘন্টু বলল, ”খেলা শেষ হল। আমরা জিতেছি।”
.
উঠোনের রকের গায়ে হেলান দিয়ে সাইকেলটা রেখেই হাঁফাতে হাঁফাতে কলাবতী দোতলার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করল। অ্যাটাচি কেসটা খাটের তলায় ঠেলে দিয়ে, ঝুলফি, গোঁফ, দাড়ি খুলে পাখাটা চালিয়েই বিছানায় নিজেকে ছুড়ে দিল। শারীরিক পরিশ্রমের থেকেও ধকল বেশি নিয়েছে মন। মাথার মধ্যে বোঁ বোঁ ঘুরছে একটা টেবিল ফ্যান। স্কুলের স্পোর্টসে গুণ্ডা সেজে শ’খানেক লোককে ভড়কি দেওয়া এক ব্যাপার। আর ডাকাত সেজে সত্যি—সত্যি ডাকাতি—ধরা পড়লে তো জেল হয়ে যাবে! এখনও সে বুঝে উঠতে পারছে না কাণ্ডটা এত মোলায়েম ভাবে সে ঘটাল কী করে? সবই কীরকম ঠিকঠাক ভাবে হয়ে গেল! ওরা দু’জন যে এত ভিতু হবে সে ভাবেনি। বাইরের কেউ তখন এসে পড়তে পারত! আসেনি। সরা যদি না বলে দিত তা হলে ওর মাকে দিয়ে কীভাবে অ্যাটাচি কেসটা বার করাত? ঠিকই বার করত তবে একটু সময় লাগত, একটু খোঁচাখুঁচিও করতে হত। ভাগ্যি ভাল। সেই অপ্রিয় কাজটা তাকে করতে হয়নি। একটা সরল অঙ্কের মতো শেষপর্যন্ত অ্যানসারটা রাইট হয়ে গেল।
দরজায় টোকা আর ”কালু, কালু” ডাক শুনে সে দরজার খিল খুলল। সুশি উত্তেজিত। ঘরে ঢুকেই এধার ওধার তাকিয়ে বলল, ”কোথায় রেখেছিস?”
কলাবতী আঙুল দিয়ে খাটের তলা দেখাল। তখন ঘন্টু এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। কলাবতী তাকে বলল, ”রাঙাদার জিনিসগুলো দিয়ে এসো। জামাটা পরে দিচ্ছি। আর একটা কথা, তোমাদের এখানে তো এসটিডি ফোন আছে, আমি কলকাতায় কাকার সঙ্গে কথা বলব। টাকাটা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
”এসটিডি আছে বাজারে বোলতা বস্ত্রালয়ে। তবে মাঝে—মাঝেই লাইন খারাপ থাকে।”
”আজ খারাপ থাকবে না। গড়ের শিবের আশীর্বাদে আজ সব কাজই পার হো যায়গা। ম্যাচের রেজাল্ট কী? সরানন্দ মহাপাত্র কী করল?”
”রাস্তায় তো দেখা হল দুটো মুনিষ আর একটা সাইকেলচড়া লোকের সঙ্গে, জিজ্ঞেস করার মতো একজনকেও পেলুম না, তবে জিতেছি যে সেটা শিওর।”
”এই ডাকাতির ব্যাপারটা কেউ যেন জানতে না পারে, সরাও নয়। জানাজানি হলে সবার হাতে হাতকড়া পড়বে। মা—দিদি হেনস্থা হয়েছে এটা সরা ভাল ভাবে নিতে পারবে না।”
সুশি অ্যাটাচি কেসটা খাটের ওপর রেখে বলল, ”তুই ছোরা দিয়ে ওদের রক্তটক্ত বার করে দিসনি তো?”
”মাথা খারাপ!” তারপরই ডাকাতের গলায় কলাবতী বলল, ”বাহার মে হামকো দো দোস্ত, সুশীল পরসাদ আউর ঘন্টেলাল বম হাতে খাড়া হায়। কোঠিমে আগ লাগায় গা। এইসব বলতেই কাজ থ্রি—ফোর্থ হয়ে গেল। বাকিটা একটু খোঁচাটোঁচা। এরা দু’জন বড়দির থেকেও ভিতু। একটু যদি চেঁচামেচি করত তা হলে পালাবার পথ পেতুম না। গড়ের শিব আমাকে আজ পার করে দিয়েছেন।” সে জোড় হাত কপালে ঠেকাল।
আর তখনই একসঙ্গে বহু লোকের হইচইয়ের শব্দ ভেসে এল। তার মধ্যে স্লোগান দেওয়ার মতো জয়ধ্বনি উঠছে। ওরা সবাই ছুটে গেল বারান্দায়। অন্তত শ’ দুয়েক নানান বয়সী লোক মিছিল করে আসছে। মিছিলের সামনে দু’জনের কাঁধে বসে রয়েছে ন্যাড়ামাথা সরানন্দ। গলায় গাঁদাফুলের মালা।
”বোলতাকে ফাইনালে তুলল কে।”
”সরানন্দ, আবার কে।”
”বংশী বাজাবে মহাপাত্র।”
স্লোগান এগিয়ে এসে বাড়ির দরজায় থামল। সরা নামল কাঁধ থেকে। ভূদেব খেটো ব্যস্ত হয়ে ভিড় সামলাচ্ছেন। ”যাও, যাও, তোমরা, এবার ওকে বিশ্রাম নিতে দাও। ছ’ছটা গোল করার ধকল কী কম! এখন ওকে রেস্ট নিতে দাও।”
কে একজন বলল, ”দাদু, ওকে ফাইনালেও পাব তো?”
”ফাইনালেও আজকের মতো ডবল হ্যাটট্রিক কিন্তু চাই।”
ভূদেব জবাব দেওয়ার আগেই অপ্রত্যাশিত বিশুদ্ধ বাংলায় সরা বলল, ”যদি তিনদিনের মধ্যে গড়ের মাঠে কলেজ তৈরির ডিসিশন আপনারা নেন, যদি এই জমিতে কলেজ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি লিখিতভাবে আমাকে দেন তবেই আমি ফাইনালে খেলব, নয়তো খেলব না।”
বিশাল জনতা চুপ। অবাক কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”শাবাস স্বরাজ দাস।”
সুশি বলল, ”ওর সব অন্যায় ধুয়েমুছে গেল।”
জনতার মধ্যে থেকে প্রশ্ন ভেসে এল। ”আপনি কি জানেন ওখানে একটা পাতালঘর আছে, সেখানে প্রেত বাস করে, তাদের হাতে অনেক মানুষ মরেছে।”
সরা পালটা প্রশ্ন করল, ”আপনারা কেউ কি পাতালঘরটা দেখেছেন?”
জনতা চুপ।
”তা হলে আসুন আমার সঙ্গে। পাতালঘরটা দেখে যান।”
সরা কয়েক পা এগিয়ে গেল। ওর সঙ্গে কেউ যেতে চাইল না। তখন ভূদেব খেটো এগিয়ে গেলেন। ”আমি যাব।” রণক্ষেত্রের সেনাপতি তলোয়ার তুলে যেভাবে সৈন্যদের আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান, ভূদেব সেইভাবে ছাতা তুলে বললেন, ”বোলতার জনগণ এসো আমার সঙ্গে। পাতালঘর চলো।”