”অ্যাঁ, কী বলছেন?” অবাক এবং ভীত গলা আর চোখ।
”ঘরে কৌন কৌন আছে?”
”মা আর আমি।”
”তুমারা বহেন কাঁহা?” ধমকে উঠল কলাবতী।
”বহেন? মানে দিদি?’ ঢোক গিলল। ”দিদি মাঠে খেলা দেখতে গেছে।”
”বহুত আচ্ছা। ঘরমে ঘুসো।” কলাবতী আঙুল দিয়ে ঘরের দরজা দেখাল। মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
”খাড়া হ্যায় কিঁউ। কেয়া কালা হো গিয়া। ঘুসসো।” কলাবতী কাঁধে একটা ধাক্কা দিল বেশ জোরেই। মেয়েটি টলে গিয়ে দরজা ধরে ফেলল। ঝট করে পকেট থেকে ছোরাটা বার করে সে স্প্রিং টিপল। ছিটকে বেরনো ফলাটার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে মেয়েটির মুখ দিয়ে ”আঁ আঁ” একটা আওয়াজ হল তারপর চিঁ চিঁ করে ”মা…মা” বলে উঠল।
”কী রে সুমি?” ভেতরে থেকে গলা শোনা গেল। ”কার সঙ্গে কথা বলছিস?”
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে কৌতূহলী চোখে শোওয়ার ঘরে ঢুকেই লম্বা, রুগণ চেহারায় সুখি দাসের চোখ স্থির হয়ে গেল। ডাকাত!
”কী, কী চাই?”
”তোম ভালাই জানতা কী চাই। কাঁহা হ্যাঁয় ওয় এটাচি কেস? লে আও,…জলদি করো…” কলাবতী ছোরাটা ঠেকাল সুমির পেটে।
”কী বলছেন? কীসের এটাচি কেস?” সুখি দাসের প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে এখন বোধশক্তি ফিরে এসেছে। গলার স্বরে জোর এসেছে।
”কীসের এটাচি কেস? দেখেগে?” কলাবতী ছোরার ডগাটা সুমির পেটে ঠেকিয়ে চাপ দিল।
”ওমা গো, পেটে ঢুকিয়ে দিচ্ছে গো।” সুমি আর্তনাদ করে উঠল।
”আভি তক নেহি ঢুকায়া লেকিন অ্যাইসি মাফিক ঢুকায় গা।” কলাবতী সুমির পেটের সামনে বাতাসে ছোরাটা বিঁধিয়ে এপাশ ওপাশ ডাইনে—বাঁয়ে আড়াআড়ি চালিয়ে বুঝিয়ে দিল তার পরের কাজটা কী হবে। সুমি দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। ”মা আমার নাড়িভুঁড়ি বার করে দেবে গো।”
”জলদি করো, জলদি করো, বার করো এটাচি। বাহার মে হামকো দো দোস্ত সুশীল পরসাদ অউর ঘন্টালাল বম হাতে খাড়া হায়। হামকো দেরি দেখেগা তো ও লোক অধৈরজ হো যায়গা। …সমঝা হাম কেয়া বোলতা? ও দোনো লোক বম মারেগা, আগ লাগায়গা এই কোঠিমে। সমঝা?”
”এটাচি—ফেটাচি এ—বাড়িতে নেই।” সুখি দাস মরিয়া হয়ে বলল। তবে গলায় তেমন জোর নেই। কলাবতী ”হা হা হা” করে হিন্দি ফিল্মের খলনায়কদের মতো কুড়ি সেকেন্ড ধরে হাসতে—হাসতে কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বাঁ হাত দিয়ে বার করে সুখি দাসের রগে ঠেকাল। তেরিয়া ভাবের বদলে এইবার ভয় ফুটে উঠল তার দু’চোখে।
কলাবতী সুখি দাসের কানের কাছে মুখ এনে খসখসে চাপা গলায় বলল, ”হামি সাতদিন ধরে সব খবর লিয়েছি। এটাচি কোথায় আছে হামি জানি। চলো রান্নাঘরমে চলো।” পিস্তলের নল দিয়ে সে সুখি দাসের মাথায় একটু জোরেই টোকা দিল। ”হামি ইয়ে ভি জানি পিছে কা ডোবামে, পলিথিনমে প্যাক করকে কেয়া রাখা হায়।”
”কে, কে বলেছে ডোবায় টাকা রেখেছি?” সুখি দাসের চোখেমুখে রাগ, গলায় তেজ।
গোঁফে আঙুল বুলিয়ে কলাবতী বলল, ”হাম শিউ মহারাজকা ভকত হায়। পাতালঘরকা ভূত হামকো পাতা দিয়া, হামকে বোলা এহি রান্নাঘরমে, পিছে কা ডোবামে তনখা হায়।” বলেই সে বিকট স্বরে গব্বর সিং মার্কা হাসি হাসতে শুরু করল।
এইবার সুখি দাসের ভেতরের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। তার এত গোপন কাজ কিনা এই ডাকাতটা জেনে ফেলেছে! এ তো সোজা বদমাশ নয়। শিবভক্ত, পাতালঘরের ভূতেদের সঙ্গে ভাবও আছে।
উবু হয়ে বসা সুমির মাথায় ছোরার ফলাটা চাঁটির মতো মেরে কলাবতী বলল, ”অ্যাই ছুকরি উঠো, রান্নাঘর চলো।”
সুমি উঠে দাঁড়াল, সুখি দাসের গলায় পিস্তলের নল দিয়ে খোঁচা মেরে কলাবতী বলল, ”রান্নাঘর, রান্নাঘর।’
দু’জনকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে কলাবতী চট করে মাচার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল লম্বা লম্বা চেলা কাঠের স্তূপের ওপরে রয়েছে একটা চটের থলি। হাঁফ ছাড়ল সে। এত ঝুঁকি নিয়ে ডাকাত সাজা তা হলে বৃথা হয়নি। সময় আর হাতে বেশি নেই। ফুটবল ম্যাচটা শেষ হওয়ার আগেই তাকে পালাতে হবে।
”পিছু ফিরো, পিছু ফিরো।” কলাবতী কর্কশ গলায় ধমক দিল। সে ছোরার খোঁচা দিল সুখির পেটে। ”দেওয়ালকা দিক মে মুখ ফিরাও।”
সুখি দাস দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। ভয়ে থরথরিয়ে সে কাঁপছে আর বিড়বিড় করে কীসব বলছে। চোখে জল। সুমির বাহুতে ছোরার ফলাটা শান দেওয়ার মতো দু’বার ঘষে কলাবতী বলল, ”তুমি ভি দেওয়াল দেখো।” সুমি সঙ্গে—সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল। কলাবতী পিস্তলটা প্যান্টে গুঁজে রাখল। একটা ছোট টুল ঘরে কোনায় রয়েছে দেখে টেনে আনল। সুমি মুখ ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল, কলাবতী ‘অ্যাই’ বলে চিৎকার করতেই সে নিমেষে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ছোরাটা দাঁতে চেপে ধরে টুলে উঠে দু’হাতে থলিটা পেড়ে নিয়ে সে ফাঁক করে দেখে নিল জিনিসটা আছে কি না। তার মুখে সাফল্যের হাসি ফুটে উঠল। বেশ মোটাসোটা অ্যাটাচি কেসটা। এবার সে পায়ে পায়ে পিছু হটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দরজা বন্ধ করে শিকল তুলে দিল। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল। তখন আর একটা ‘হোওওও’ বোলতার আকাশে পাখির মতো ডানা ছড়িয়ে পাক দিচ্ছে।
”কালু শিগগিরি, এদিকে, এদিকে।” সুশির চাপা গলা শোনা গেল। তখন বাবার সড়কে জনমানব নেই। চশমা আর ক্যাপ চটপট খুলে, ছোরাটার ফলা ভাঁজ করে নিয়ে কলাবতী পকেটে ভরল। রান্নাঘরের দরজা ধাক্কাবার অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে। সাইকেল হাতে ঘন্টু দাঁড়িয়ে। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে, মুখ টসটসে। কারও তখন কথা বলার মতো অবস্থা নয়।