ক্লাবঘরের সামনে দড়ি দিয়ে ঘেরা ভি আই পি এনক্লোজার। সেখানে চেয়ারে বসে কলাবতী, সুশি আর ঘন্টু। তাদের কিছুটা উত্তেজিত, উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে। বি এস সি দল মাঠে নামল সরানন্দকে ছাড়াই। বুট তখনও এসে পৌঁছয়নি। ব্যাংকাকা মাঠে গিয়ে রেফারিকে অনুরোধ করলেন পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে খেলা শুরু করতে। জেলার পাশকরা রেফারি অনুরোধ রক্ষা না করে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটেতে কিক—অফের হুইসল দিলেন। তিন মিনিটের মাথায় বি এস সি সেমসাইড গোল খেয়ে বসল। স্টপার একটু জোরেই আমচকা ব্যাক পাস করেছিল প্রথম পোস্টে। গোলকিপার ছিল দ্বিতীয় পোস্টে। এর পরই মাঠ ঘিরে তুমুল হাততালি উঠল ওড়িশার সরানন্দ মহাপাত্রকে মাঠে নামতে দেখে। ওরা তিনজন নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে হাততালি থামার আগেই চুপিসারে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল।
সুশি বলল, ”কালু তাড়াতাড়ি কর, দৌড়ো।”
ঘন্টু বাধা দিয়ে বলল, ”একদম নয়, লোকের চোখে পড়ে যাবে, বরং একটু জোরে হাঁটো। রাঙাদা রেডি হয়ে থাকবে বলেছে।”
রাস্তায় জনমানুষ নেই যে ওরা চোখে পড়বে। মানুষজন তো এখন ফুটবল মাঠে। সুশিদের বাড়িতে পৌঁছতে মিনিট পাঁচেক লাগল। রাঙাদা সত্যিই রেডি হয়ে ছিল মেকআপের বাক্স খুলে। ”আসছি।” বলেই কলাবতী ছুটে দোতলায় শোয়ার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। একটু পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল অন্য এক কলাবতী। পরনে নীল জিনস, পায়ে স্নিকার, ঘন্টুর এনে দেওয়া ঢলঢলে কালো ফুলশার্ট, চোখে সানগ্লাস, চুল টেনে গোছা করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে প্রাচীন জাপানি যোদ্ধা সামুরাইদের মতো বাঁধা। মাথায় ক্রিকেটারদের ক্যাপ। বারান্দার দু’ধারে দেখে নিয়ে ছুটে নেমে এল পাতলা গড়নের শ্যামলারঙের ছিপছিপে একটা ছেলে।
নীচের ঘরে ঢুকতেই কলাবতীকে দেখে ঘন্টু আর রাঙাদার চক্ষু চড়কগাছ। সুশি বলল, ”হাই।”
”কেয়া হাই হাই করতা।” কর্কশ চোয়াড়ে স্বরে কলাবতী বলল। ”জানতা হাম কৌন হ্যায়? ভাগলপুরকা কালু প্রসাদ পাসোয়ান হ্যায়। হাই মাই করেগা তো এক ঝাপ্পড় লাগায়গা।” বলে সে সুশির দিকে এগিয়ে চড় মারার জন্য হাত তুলল।
”কালুজি মুঝে মাফ কিজিয়ে।” সুশি মুখে ভয় ফুটিয়ে হাত জোড় করল।
রাঙাদা বলল, ”তা হলে কার্ভালোর দাড়িটা লাগিয়ে দি।”
কলাবতী বলল, ”না, না, সাহেবের কটা দাড়ি নয়।”
”তা হলে শাজাহানের দাড়ি?”
”ফ্রেঞ্চকাট নেই?” সুশি বলল।
”কী যে বলো, বড় বড় মেকআপ ম্যানদের কাছে—”
থুতনিতে দাড়ি লাগাবার পর সবাই নানান দিক থেকে কলাবতীকে দেখল। ঘন্টু বলল, ”গাল দুটো বড্ড প্লেন, নরম নরম দেখাচ্ছে, একটা লম্বা ঝুলফি হলে ভাল হয় আর পাতলা একটা গোঁফ, চিনেদের মতো।”
তিন মিনিটের মধ্যে কলাবতীর গোঁফ ও ঝুলফি গজিয়ে গেল।
”পিস্তল?” সুশি বলল।
রাঙাদা একটা খেলনা পিস্তল বাক্স থেকে বার করল, একটা ফোল্ডিং ছোরাও। স্প্রিং টিপতেই বেরিয়ে পড়ল ঝকঝকে ছ’ ইঞ্চি ফলা। কলাবতী পিস্তলটা কোমরের কাছে প্যান্টে গুঁজে ছোরার ফলাটা মুড়ে হিপপকেটে রাখল।
”রেডি। সরার বাবা এখন শ্যাওড়াফুলিতে কাজে গেছে। বাড়িতে এখন মা আর দুই মেয়ে। ঠিক আছে। এবার অ্যাকশন।” স্বাভাবিক স্বরে কলাবতী বলল।
কিন্তু কিন্তু করে ঘন্টু বলল, ”এই ড্রেসে কলকাতায় হাঁটলে কেউ তাকাবে না কিন্তু বোলতায় লোকে তাকাবে। মিনিট চার—পাঁচ তো এখান থেকে দাসপাড়া হেঁটে যেতে লাগবে।”
সুশি সমস্যাটা মিটিয়ে দিল, ”এর ওপর একটা শাড়ি পরে নিলেই হবে। আমরা তো দাসপাড়া পর্যন্ত সঙ্গে যাচ্ছি। ঘন্টু দূর থেকে বাড়িটা দেখিয়ে দিলে কালু শাড়ি খুলে ওর হাতে দিয়ে এগিয়ে যাবে। ঘন্টু, তুমি ব্যাংকাকার সাইকেলটা নাও। কাজ হয়ে গেলেই কালুকে সাইকেলে পাঁইপাঁই পালাতে হবে। আমি শাড়ি আনছি।”
দোতলা থেকে সুশি তার ধনেখালি ডুরে শাড়ি নিয়ে এল। আটপৌরে ভাবে পরে কলাবতী ক্যাপ আর সানগ্লাস খুলে ঘোমটা দিয়ে সেটা টেনে রইল এমনভাবে যাতে দাড়ি ও জুলফি ঢাকা পড়ে। জুতোটা অবশ্য ঢাকা গেল না।
”হর হর মহাদেও।” সুশি স্লোগান দেওয়ার ভঙ্গিতে চাপা গলায় বলল। ”এবার নয়া বর্গির হানা শুরু হবে।”
ওরা বাড়ি থেকে বেরনো মাত্র শুনল মাঠ থেকে ভেসে আসা ”হোওওও” শব্দে প্রচণ্ড উল্লাসধ্বনি। ঘন্টু আনন্দ চেপে বলল, ”বোলতা গোল দিল।”
বাবার সড়কে ওরা দেখা পেল শুকনো ডালপালা মাথায় নিয়ে চলা এক বুড়ির। একটি কুকুর, দুটি ছাগল আর যাত্রীভর্তি এক ট্রেকারের। দাসপাড়ায় ঢোকার মুখে আবার ”হোওওও” শব্দ বোলতার আকাশ ভরিয়ে দিল। সুশি বলল, ”বোধ হয় সরানন্দর অ্যাকশন শুরু হয়েছে।” ঘন্টু হাসি চেপে মাথা নাড়ল। কলাবতী গম্ভীর। সে এখন মনোনিবেশ করছে আসন্ন অ্যাকশনের জন্য।
”ওই যে নিমগাছের পেছনে, টালির চালের বাড়িটা।” ঘন্টু প্রায় সত্তর গজ দূর থেকে উত্তেজিত চাপা গলায় দ্রুত কথা বলে আঙুল তুলে দেখাল। ”শাড়িটা খুলে দাও। আমি আর সুশি সড়কে দাঁড়াচ্ছি।”
গলা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ম্যাক্সি পরা, গোলগাল মুখ মাঝারি আকৃতির সরার ছোড়দি ঘর থেকে সবে বাইরের রকে বেরিয়েছে, হাতে একটা বালতি। বেড়ার দরজা সরিয়ে বিদঘুটে সাজের একটা লোককে ঢুকতে দেখে থমকে দাঁড়াল।
”কাকে চাই?”
”সব কোই কো।” কলাবতী একলাফে সিঁড়ির দুটো ধাপ পেরিয়ে রকে উঠল। ”ঘর মে কৌন কৌন হ্যায়?” ওর স্বরে যথাসম্ভব পুরুষালি রুক্ষতা আনার চেষ্টা।